বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে অনন্য অর্জন by ড. আশকার ইবনে শাইখ

আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সমুদ্র আইনসংক্রান্ত যে রায়টি পাওয়া গেল, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অর্জন; যে অর্জনের গর্বিত অংশীদার বাংলাদেশের জনগণ। আমরা যারা প্রবাসে আছি, তাদের কাছেও বিষয়টি সমভাবে গর্ব ও আনন্দের।

অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতা-উত্তর বিগত চার দশকে এটি আমাদের অবশ্যই বৃহত্তম এবং দূরদর্শী কূটনৈতিক অর্জনও বটে। দীর্ঘদিন ধরে ইস্যুটি ঝুলে ছিল এবং এ নিয়ে মাঝেমধ্যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা, দূরদর্শিতা, পদক্ষেপ- সব কিছুরই জয় হয়েছে; যে জয় আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ব্যাপক ইতিবাচকতারও সৃষ্টি করেছে। বর্তমান সরকার নানাবিধ বাধা-প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল এবং সুফল লাভ করেছে। সরকার, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ জন্য ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এ মামলার প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত কোর্স করেছেন বলে শুনেছি। এ ক্ষেত্রে তাঁর দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা- সবই প্রশংসার দাবিদার। তিনি বর্তমান সরকারের অবশ্যই একজন সফল মন্ত্রী। অতীতে কোনো সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি ভাবার প্রয়োজনই তেমনভাবে মনে করেনি, সে ক্ষেত্রে তাদের তরফে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি তো পরের ব্যাপার। ধন্যবাদ জানাতে হয় তাঁদেরও, যাঁরা এই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং আইনবিদদের। এর মধ্য দিয়ে আরো একটি সত্য পুনর্বার প্রতিষ্ঠিত হলো, যদি যথাযথ কূটনৈতিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করা যায়, তাহলে দেশ যত ছোট কিংবা দরিদ্রই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক ফোরামে তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জেতা সম্ভব।
বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, 'বিএনপি এতে খুশি হয়েছে, তবে এ কৃতিত্ব সরকারের নয়। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তর ভালো কাজ করেছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।' মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন দায়িত্বশীল নেতা যখন এমন বক্তব্য রাখেন, তখন বিস্মিত না হয়ে গত্যন্তর থাকে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি সরকারের অংশ নয় কিংবা সরকার কাঠামোর অঙ্গ নয়? আমাদের দেশে বিরোধী দলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বরাবরের অভ্যাস সব কিছুতেই যুক্তিহীন বিরোধিতা করা, যুক্তিহীন মন্তব্য কিংবা কথাবার্তা বলে সব কিছুকেই অপরাজনীতির খেলার অংশ করে ফেলা। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন রাজনৈতিক নেতা এত অদূরদর্শী কিংবা কাঁচা মন্তব্য কিভাবে করেন, সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। তবে যদি মহাজোট সরকার এ ব্যাপারে সুফল বয়ে আনতে সক্ষম না হতো, তাহলে বিরোধী দল সরকারের ব্যর্থতার চিত্র প্রকট করে তুলে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। যদিও তারা এ ব্যাপারে অতীতে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি, তবুও দেশের বিদ্যমান নেতিবাচক রাজনীতির ধারায় তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুন একটি ইস্যু যোগ করার অবকাশ পেত। মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তি হলো আন্তর্জাতিক আদালতে প্রদত্ত রায়ের মাধ্যমে। আমরা সাগরে যে বিপুল অংশের সার্বভৌমত্ব অর্জন করলাম, তা বিরাট সাফল্য এবং এই সাফল্যকে যথাথযভাবে কাজে লাগাতে হবে একই রকম দক্ষতা ও দূরদর্শিতার মধ্য দিয়েই। ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে যে বিরোধ রয়েছে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সে ক্ষেত্রেও আমরা জয়ী হব- এ প্রত্যাশা সংগতই এখন যথেষ্ট পুষ্ট। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সম্ভাব্য যে গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, তা মোট ২৮টি ব্লকে ভাগ করা। এর মধ্যে ১৭টি মিয়ানমার এবং ১০টিতে ভারত তাদের মালিকানা দাবি করে আসছিল। একটি মাত্র বিরোধহীন ব্লক ছিল বাংলাদেশের। এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ এখন ১৮টি ব্লকের মালিকানা পেল এবং তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। হেগের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে ভারতের সঙ্গে বিরোধের ব্যাপারে যে মামলা রয়েছে, ২০১৪ সালের মধ্যে তারও রায় পাওয়া যাবে- এমনটি আশা করা যাচ্ছে এবং সংগতই এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে সে প্রত্যাশা করছি।
একটি দেশের স্থলসীমার মতোই জলসীমাও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা (পানির তলদেশ এবং উপরিদেশ) বিপুল সম্পদে পরিপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। আমাদের জ্বালানি সংকট নিরসনে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে এ হচ্ছে বিপুল ভাণ্ডার। পেট্রোবাংলা ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে তাদের প্রস্তুতি শুরু করেছে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, যাতে আমাদের সম্পদের মালিকানা জনগণের থাকে এবং এর যথাযথ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে সার্বিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রাখতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের সাফল্য আমাদের প্রত্যাশার দিগন্তও সংগতই বিস্তৃত করেছে। গণতন্ত্রের ব্যাপারে মিয়ানমার এখনো দ্বিধাগ্রস্ত, তবে গণতন্ত্রের অভিমুখেই শেষ পর্যন্ত পা ফেলতে বাধ্য হচ্ছে মনে হয়। এটি গণতান্ত্রিক বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর জন্য সুবার্তা। এমন দৃষ্টান্ত থাকছে যে বিজয় ছিনিয়ে এনেও অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। এর আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী গবেষক

No comments

Powered by Blogger.