মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও 'ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট' by শান্তনু মজুমদার

মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজ যেভাবে দিনের পর দিন রাজনীতিকের সমালোচনার নামে রাজনীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছে তা অব্যাহত থাকলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। কে না জানে যে, রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, প্রেম, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম, গৃহস্থালি, দাম্পত্য_ কী নয়?

'গণতন্ত্র ঘাটতি' পর্ব অতিক্রম করে 'সুষম গণতন্ত্র' পেতে হলে আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়, গণতন্ত্রকে 'উপচে পড়া' পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইলে বর্তমানকার কথামালা নির্ভর 'বাকবাকুম গণতন্ত্র' নয়, বরং কোনো ধরনের বাড়তি গুণ আরোপ বা অযথা প্রত্যাশা বাদ রেখে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সারকথাগুলোতে মনোনিবেশ করতেই হবে রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের। এ কাজটা সেভাবে হচ্ছে না


অনেকে দাবি করেন, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নত শাসন ব্যবস্থা নাকি আর নেই। এহেন দাবির সঙ্গে পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্বিমত ব্যক্ত করা সম্ভব। তবে লোকপ্রিয়তার বিচারে এটি যে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা_ তা নিয়ে সহমত পোষণ ছাড়া উপায় নেই। উল্লেখ্য, আজকাল গণতন্ত্র বলতে ব্যক্তিমালিকানাময় পুঁজিবাদের অধীন পশ্চিমা উদারনীতিক গণতন্ত্রকেই শুধু বোঝানো হয়। কারও পছন্দ হোক বা না হোক, গণতন্ত্রের এই মডেলটি এখন বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সর্বাধিক পছন্দের। লোকেরা গণতন্ত্র বলতে পশ্চিমা উদারনীতিক গণতন্ত্র বোঝে। এই গণতন্ত্রে শাসনক্ষমতা কে বা কার হাতে থাকবে তা নির্ধারণে ভোটকেন্দ্রিক সম্মতিকে বোঝানো হয়; শাসক পরিবর্তন হতে হয় নির্ধারিত বিরতিতে। দলের নেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দলের লোকদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রধান বিষয়। গণতন্ত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নয় বরং সংবিধানসম্মত পন্থাতে সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্তনের কথা বলা হয়। এই গণতন্ত্র মনুষ্য সমাজে অশান্তি নির্মাণে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ অসমতার বিষয়টি সুরাহা করতে পারে না। তবে ঠিকমতো চললে গরিবির অবসান ঘটানো যায়। ক্ষমতাসীন শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সে বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। গণতন্ত্র রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের ব্যবহারেরও বিরোধিতা করে। এসব শর্ত পূরণ হলে সম্মতির-সংকট অতিক্রম সম্ভব হয়; সহিংসার আশঙ্কা দূরীভূত হয়। বাঙালি সাতচলি্লশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এ বিষয়গুলোই চেয়েছে। না পেয়ে বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। 'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা'_ কথাটা কথার কথা মাত্র নয়। ভুলতে কই পারা যায় তিন মিলিয়ন মানুষের প্রাণ, অপরিমেয় সম্পদহানি, প্রতিবেশী দেশে এক কোটির বেশি শরণার্থী, বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিচালিত হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞে সহায়কের ভূমিকায় বাঙালি।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মজ জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে 'ওদের' তথা পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে 'আমাদের' অর্থাৎ বাঙালিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে আসে। কিন্তু গণতন্ত্র অর্থাৎ কি-না উদারনৈতিক গণতন্ত্র কই আসে স্বাধীনতার হাত ধরাধরি করে? উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে বাঙালিদের কাছে মডেল ছিল ওয়েস্ট মিনস্টার তথা ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্র। চুয়াত্তরে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে নিমিষে রাষ্ট্রপ্রধান শাসিত ব্যবস্থায় চলে যাওয়ার মধ্যে গণতন্ত্রের দেখা মেলে না। যদি গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে, তাহলে বিদ্যমান পরিস্থিতির যুক্তি দেখিয়ে এহেন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা বা সম্মতি গ্রহণের অনুপস্থিতিকে যৌক্তিকতা দেওয়া যায় না। প্রথম গণতান্ত্রিক শাসনামলে গণতন্ত্রকে প্রশ্রয় না দেওয়ার আরও উদাহরণ দেওয়া যায় চাইলে। সূচনা পর্বে যে 'ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট' বা 'গণতন্ত্র ঘাটতি' দেখা দেয়, বর্তমানে তা থেকে উত্তরণ ঘটে গেছে_ এমন দাবি করা মুশকিল। এই বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। অবশ্য তাই বলে বুর্জোয়া গণতন্ত্র শক্তিশালী হওয়ার পথে আমরা একটুও এগুতে পারিনি_ বলাটা হবে দুঃখবিলাস অথবা উদ্দেশ্যমূলক। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে সামরিক শাসনগুলো সম্পর্কে আলোচনা অবান্তর। কথা হতে পারে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে 'গণতন্ত্র ঘাটতি' প্রসঙ্গে।
'ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট' বলতে কী বুঝব? স্যানফোর্ড লেভিনসন মনে করেন, এটি এমন এক পরিস্থিতি যখন দৃশ্যত গণতান্ত্রিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের শর্তগুলো পূরণে ব্যর্থ হয়। রাজনীতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পর্কহীনতা তৈরি হয়ে যাওয়াটাও এই ব্যাধির আরেকটি লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন? উত্তর হয় এই যে, এই দেশে 'গণতন্ত্র ঘাটতি' আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে। ফলে গণতন্ত্র স্পর্শকাতরতায় ভুগছে; অগণতান্ত্রিক শক্তির একটু টোকাতেই এই গণতন্ত্র কেঁপে কেঁপে উঠছে। এ প্রসঙ্গে এক-এগারোর প্রায়-দুই বছর স্মর্তব্য। কেন এমন হচ্ছে? মনে হয় যে, বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থাটি বাজে-বণিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকার সঙ্গে বিদ্যমান 'গণতন্ত্র ঘাটতি'র সম্পর্ক আছে। যাদের রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত করানো হয়, তাদের বড় একটি অংশ আসলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে অতি-সস্তা শ্রমের সুযোগ ব্যবহার করে ধনী দেশগুলোর জন্য পণ্য উৎপাদন, দেশীয় শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ করা বিদেশি পণ্যের আমদানি, আমদানি-রফতানিজনিত কমিশনবাজি বা সামরিক-বেসামরিক আমলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের বদৌলতে অতি-ধনী হয়ে ওঠা মানুষজন। তাদের কাছে রাজনীতি জনসেবা হওয়ার কারণ নেই বরং নিজের বা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষাই বড় কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় 'বাইশ পরিবারের' হাত থেকে অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে আনার কথা ছিল। তা হয়নি মোটেই।
এদিকে মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজ যেভাবে দিনের পর দিন রাজনীতিকের সমালোচনার নামে রাজনীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছে তা অব্যাহত থাকলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। রাজনীতিপ্রীতির স্থলে রাজনীতিবিমুখতাই এখন ফ্যাশন। এই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন পরে হয়তো রাজনীতিবিরোধিতাই হবে ফ্যাশন। অথচ কে না জানে যে, রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, প্রেম, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম, গৃহস্থালি, দাম্পত্য_ কী নয়? 'গণতন্ত্র ঘাটতি' পর্ব অতিক্রম করে 'সুষম গণতন্ত্র' পেতে হলে আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়, গণতন্ত্রকে 'উপচে পড়া' পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইলে বর্তমানকার কথামালা নির্ভর 'বাকবাকুম গণতন্ত্র' নয়, বরং কোনো ধরনের বাড়তি গুণ আরোপ বা অযথা প্রত্যাশা বাদ রেখে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সারকথাগুলোতে মনোনিবেশ করতেই হবে রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের। এ কাজটা সেভাবে হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, নব্বই-পরবর্তী সময়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে যখন যেটি ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে
জোরদার অবস্থান নেয়। সুশীল সমাজও উচ্চকণ্ঠ হয়। কিন্তু কেন? তিন জোটের রূপরেখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা স্বীকার করে নিলেন যে, সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা ব্যর্থ। অতএব চাই অনির্বাচিত লোকদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, যারা একটি নির্বাচন করিয়ে দেবেন! এ কেমন কথা! বাংলাদেশের রাজনীতিকরা কি এতটাই নিম্নমান যে, তারা একটি সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরে পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবেন না? পারস্পরিক অবিশ্বাস আছে_ এ কথা সত্য। কিন্তু তাই বলে অনির্বাচিত লোকদের হাতে ক্ষমতা? তিয়াত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত নির্বাচনগুলো হিসাবে আসে না। সামরিক আমলের নির্বাচন হিসাবে ধরতে হয় না। পরিপূর্ণ জালিয়াতিনির্ভর এসব নির্বাচনের কোনো আগা-মাথা নেই। দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক আমলে খালেদা জিয়ার চার দিন স্থায়ী একদলীয় নির্বাচনটি কিংবা মাগুরা উপনির্বাচনের মতো গোটাকয় ঘটনা কি জনমের তরে বাংলাদেশি রাজনীতিকের মুখে চিরস্থায়ী কলঙ্কের কালি মেখে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট? অরাজনৈতিক লোকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার বিধান চিরস্থায়ী করার জন্য যথেষ্ট? রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত তত্ত্বে টমাস হবস, জন লক ও জ্যাঁ জ্যাঁকুয়েস রুশো আমাদের জানান যে, রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পূর্ববর্তী পর্যায়ে 'প্রকৃতির রাজ্যের' লোকেরা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সার্বভৌমের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। সম্মতিহীন লোকের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়নি কিন্তু। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্মতিবিহীন সরকার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে সময়ে সময়ে এর পক্ষ নেয়, তা গণতন্ত্রের চেতনাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং 'গণতন্ত্র ঘাটতি'র শক্তিশালী নির্দেশক।
বাংলাদেশে 'গণতন্ত্র ঘাটতি' পরিস্থিতিকে নোয়াম চমস্কির চিন্তার আলোকেও দেখা যেতে পারে। ২০০৯ সালের আগস্টে মার্কিন গণতন্ত্র প্রসঙ্গে অনলাইন নলেজ ফোরাম 'বিগ থিংক'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, যখন লোকজনের মধ্যে একটা অক্ষমতা, একটা অসহায়ত্বের বোধ কাজ করে, যখন মনে হয়, সবকিছু চালাচ্ছে অন্য কেউ, আমার কোনো কিছু করার মতো নেই_ তখন বুঝতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থাটির মধ্যে 'গণতন্ত্র ঘাটতি' বিরাজ করছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী নির্দেশ করছে?

স ড. শান্তনু মজুমদার : শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.