আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-২৫)-বন্ধুত্বের মধ্যে শ্রেণীভেদ ছিল না by আলী যাকের

আমাদের ইস্ট এন্ড ক্লাবের তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা আঙিনার মধ্যে প্রতি শরতে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য কোর্ট কাটা হতো। এ ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন ভুলুদা, যাঁর আরেকটি ডাক নাম ছিল 'চিনিদা'। আমার এখনো মনে আছে, সন্ধ্যায় খেলা শুরু হওয়ার আগে যখন আলোগুলো কেবল জ্বালানো হয়েছে, ভুলুদা তাঁর সমবয়সী বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে কোর্টের পাশে বসে

আড্ডায় জমেছেন, তখন ঠাকুরের দোকানে চায়ের অর্ডার যেত। ওঁরা জমিয়ে চা পান করতেন। ভুলুদা ঠাট্টা করে চা দোকানের ছেলেটিকে বলতেন, 'আমার চায়ে চিনি দিতে ভুলু না।' এই বাক্যটির মাধ্যমে, ইচ্ছাকৃত ভুল উচ্চারণের মাধ্যমে তাঁর দুটি নামই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতো। আমরা সবাই হেসে উঠতাম। প্রসঙ্গত, ঠাকুরের দোকানের একটি ছোট বর্ণনা দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। গলায় কণ্ঠির হার, লম্বা চুল, ফতুয়া এবং লুঙ্গি পরা এই ঠাকুর কোথা থেকে এসে ইস্টএন্ড ক্লাবের পাশেই তার বেড়ার দোকান দিয়েছিল, তা আমরা জানতাম না। ঠাকুরের একটি চোখ ছিল না। তার ব্যক্তিগত বৃত্তান্ত সম্পর্কে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। করলে পরে সেই এক চোখা ঠাকুর এক অনলবর্ষী দৃষ্টি নিক্ষেপ করত প্রশ্নকর্তার দিকে। তাকে না ঘাঁটালে সে আপন মনে গুনগুন করে কীর্তনের সুর ভাজত আর ভীষণ মনোযোগে প্রায় শিল্পীর অভিনিবেশ সহকারে শিঙ্গাড়া বানাত। আলু আর পুঁদিনাপাতার পুর দেওয়া সেই অতি ছোট আকারের শিঙ্গাড়া আমার এ পর্যন্ত খাওয়া সব শিঙ্গাড়ার সেরা। এমন স্বাদু খাবার মনে হয় আমার জীবনে আমি খুব বেশি খাইনি। বাবা আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন কেবল শুক্র ও শনিবার সন্ধ্যায় ব্যাডমিন্টনের মাঠে যাওয়ার। মনে আছে, সারা সপ্তাহ এই দুই সন্ধ্যার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। ক্লাবের মাঠে অত্যুজ্জ্বল আলো জ্বলছে। ঢাকার চৌকস সব ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় জমায়েত হয়েছে সেখানে। প্রায় ছবির মতো খেলা চলছে। দেখতে দেখতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়তাম। হয়তো কোনোদিন বড়দের খেলা সাঙ্গ হলে আমাদের খেলার সুযোগ আসত। সেদিন কী আনন্দ, কী আনন্দ! এই কোর্টে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক নামজাদা খেলোয়াড়ের খেলা দেখেছি। যেমন চট্টগ্রামের খেলোয়াড় অজিত দত্ত ও ললিত দত্ত, যাঁরা দত্ত ব্রাদার্স নামে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। চট্টগ্রামের দামপাড়া থেকে এসে পূর্ব পাকিস্তান ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন এই দুই ভাই। এ ছাড়া নারিন্দার পাঁচভাই ঘাট লেন থেকে আসতেন করিম ব্রাদার্স। তাঁরাও ঢাকার প্রধান ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতাগুলোর নামজাদা খেলোয়াড় ছিলেন। এ ছাড়া করুণাদা, সিরাজ ভাই, তারেক ভাই, চিত্তদা, অনিমেষদা, কবির ভাই_এঁরা তো ছিলেনই। তারেক ভাইয়ের সঙ্গে এখনো আমার যোগাযোগ আছে। তাঁকে অবশ্য আমরা তাঁর ডাক নাম 'কোকিল ভাই' নামে ডাকতাম। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের ধূপখোলা মাঠে প্রতি শীতে অ্যাথলেটিঙ্রে প্রতিযোগিতাও হতো। সেখানে ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ তেল চকচকে চেহারার আদি ঢাকাবাসী একজন সব সময় চ্যাম্পিয়ন হতেন। তাঁর নাম ছিল খালেক। আমরা তাঁকে খালেক ভাই বলে ডাকতাম। স্যান্ডো গেঞ্জি আর নীল চকচকে স্যাটিনের শর্টস পরে যখন বুলেটের মতো খালেক ভাই দৌড়াতেন, তখন আমাদের মনে হতো সেই বিশ্ব বিখ্যাত জেসি ওয়েন্সের কথা। তাঁকে ঠাট্টা করে জেসি বলেও ডাকা হতো। প্রতিদিন কাক-ভোরে খালেক ভাইয়ের নিয়ম ছিল ধূপখোলা মাঠে অন্তত এক ঘণ্টা দৌড়ানো। আমাদের দেখলেই আদি ঢাকাইয়া ভাষায় বলতেন, 'কী মিয়া? লাটের বাট আইছো নিহি? ফজরে বিছানার থে উঠতে পারো না?' অতএব আমরা খালেক ভাইকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। তিনি ছিলেন আমাদের হিরো। তাঁর একটি ডাক নাম দিয়েছিলাম আমরা_ব্ল্যাক ম্যাজিক। সেকালে ওই নামের একটা স্বাদু চকোলেটও কিনতে পাওয়া যেত। খেলার পর্ব শেষ করি আমার আরেক বন্ধু সম্পর্কে বলে। তার কথা না বললে আমার খেলাধুলা-জীবনের স্মৃতি রোমন্থন অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। এই বন্ধুর নাম ছিল ওয়াসেক। আমার চেয়ে বয়সে নিশ্চিতভাবেই অনেক বড় ছিল সে। খুবই ছোটখাটো-গাট্টাগোট্টা চেহারার লোক। আমরা ডাকতাম বেবি অস্টিন। সে যখন বল নিয়ে দৌড়াত, তখন সেই দৃশ্য ছিল দেখার মতো। খুব ভালো যে খেলত, তা নয়। তবে উদ্যমের অভাব কখনোই ছিল না। আমার প্রতি তার এক বিশাল অভিযোগ ছিল; যেটা, তার ভাষায়ই বলি, 'অ মিয়া, তোমার লাহান এউগা সরিল (শরীর) থাকলে কেউ আমার সামনে খারাইয়ার পারত না। উষ্ঠা মাইরা ব্যাবাক রে কাইত কইরা ফালাইতাম। সরিলডা পাইছো ঠিকই, মগর কাজে লাগাইবার পারলা না।' আমরা ওকে নিয়ে হাসতাম। ও আরো চটে যেত। তবে সবশেষে বলতেই হয়, আমাদের গলাগলি ভাব ছিল। রোজ ভোরে প্র্যাকটিস শেষে আমাদের গেণ্ডারিয়ার পুকুরে গোসল সেরে ওয়াসেক একটি বিশাল ঝাঁকা মাথায় নিয়ে সূত্রাপুর বাজারে যেত। সেই ঝাঁকায় থাকত টাটকা শাক-সবজি আর কিছু আনাজপাতি। এই ছিল ওর পেশা। ওকে সবাই শাকওয়ালা বলে জানত। ধূপখোলা মাঠ সংলগ্ন নামাপাড়ায় একটা ছোট্ট ঘরে ছিল ওর বাস। লেখাপড়া কতদূর করেছে, আমরা জানতাম না। তবে সে জন্য আমাদের বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তা আটকে থাকেনি। এই একটি ব্যাপার ছিল তখন। বন্ধুতার মধ্যে শ্রেণীভেদ তখন কোনো ব্যাপার ছিল না। আমি মনে করি, জীবনের এই যে সহজিয়া দর্শন, সব মানুষের সঙ্গে সমান সম্পর্ক স্থাপন করা, এটাই বোধ হয় অনেক বেশি বড় কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.