শেকড়ের ডাক-জেনেশুনে বিষপান ও সীমাহীন উদাসীনতা by ফরহাদ মাহমুদ

আমাদের জীবনের মুখ্য বা প্রধান প্রধান সমস্যা নিয়েই আমরা এত বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকি যে গৌণ বা পরোক্ষ সমস্যাগুলো দেখারই সময় থাকে না। কিন্তু এই পরোক্ষ সমস্যাগুলোই একসময় প্রধান সমস্যাগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়ে আমাদের গোটা জীবনটাকে বিষময় করে তুলতে পারে। তেমনি একটি সমস্যা হলো, খাদ্যে বিষ বা বিষাক্ত দ্রব্যের মিশ্রণ।

শাকসবজি, ফলমূল, দুধ, মাছ, মুড়ি, রঙিন খাদ্রদ্রব্য, কোথায় নেই বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ! কিন্তু এসব নিয়ে কতটা ভাবছি আমরা? কি পদক্ষেপ নিচ্ছি এসব প্রতিরোধে? সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে এ পর্যন্ত? আগে কিছু কিছু এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলত, ভেজালকারীরা খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশাতে ভয় পেত। এখন সেই অভিযানও প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে ভেজালকারীরা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
ভেজালকারীরা দুধে ও মাছে ফরমালিন মেশাচ্ছে। ফলমূল পাকাতে কার্বাইড ব্যবহার করছে। এমনকি ফলমূল বাজারজাত করার আগে সেগুলোর পচন ও পোকার আক্রমণ ঠেকাতে বিষাক্ত তরল দ্রবণে চুবিয়ে নিচ্ছে। ইউরিয়া দিয়ে মুড়ি ভাজছে। শাকসবজিতে এমন সব বিষ ব্যবহার করছে, যেগুলো প্রয়োগ করলে এক মাসেরও বেশি সময় সেই শাকসবজি খাওয়ার অনুপযোগী থাকে। অথচ এসব বিষ প্রয়োগের পরের দিনই সেসব শাকসবজি বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে, ভোক্তার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সারা দুনিয়ায় ডিডিটির ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় সেই নিষিদ্ধ ডিডিটি ব্যবহারের খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে শুঁটকিতে ডিডিটি ব্যবহারের কথা প্রায়ই শোনা যায়। আটা, সুজি, গুড়সহ অনেক খাদ্যদ্রব্যকে ঝকঝকে সাদা বা আকর্ষণীয় করার জন্যও নানা রকম বিষাক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এগুলো যে কেবল দেশের ভেতরেই হচ্ছে তা নয়। দেশের বাইরে থেকেও আসছে এসব বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো খাদ্যসামগ্রী। বছরখানেক আগে চীন থেকে আসা গুঁড়াদুধে মেলামাইনের উপস্থিতি নিয়ে বেশ সোরগোল হয়েছিল। ভারত ও মিয়ানমার থেকে চোরাপথে আসা খাদ্যদ্রব্যেও ব্যাপক ভেজালের উপস্থিতি আছে বলে জানা যায়। খাদ্যে এ ধরনের বিষের উপস্থিতি তাৎক্ষণিক মৃত্যু না ঘটালেও ধীরে ধীরে শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটায়। এসবের ফলে ক্যান্সার হতে পারে, কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে যেতে পারে এবং আরো নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা সম্ভব।
২০১০ সালের অক্টোবরে ঢাকায় হেপাটোলজি সোসাইটি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ লিভারের নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে এক কোটি ৮০ লাখ লোক কিডনির সমস্যায় ভুগছে। এ ছাড়া দুই কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত, এর মধ্যে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। আর ক্যান্সার যদি কারো শরীরে বাসা বাঁধে, তখন বিষয়টি আর গৌণ থাকে না, প্রধান সমস্যা হিসেবেই দেখা দেয়। তখন শরীর যায়, অর্থ যায়, সময়ও যায়_এক কথায় সবই যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব স্বাস্থ্যসমস্যা ক্রমেই প্রকট রূপ ধারণ করছে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সুস্থ ও কর্মক্ষম লোক খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ শুধু এই সমস্যার কারণে রোগগ্রস্ত হওয়া নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও বেশ কিছু রোগ নতুন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসঙ্গে পরিবেশ ও জলবায়ু দূষণজনিত সমস্যাগুলো তো আছেই।
তাই গৌণ বলে খাদ্যে বিষ মেশানোর সমস্যাটিকে এভাবে উপেক্ষা করা উচিত হবে না। যার যতটুকু প্রয়োজন সেই মোতাবেক গৌণ সমস্যাগুলোকেও উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে হবে। আর সে জন্য সমস্যার প্রকৃতি জানতে হবে, তদনুযায়ী যেমন ব্যক্তিগতভাবে, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা ধরনের প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যক্তিগত সচেতনতা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন ফরমালিন দেওয়া মাছ কেটে পানিতে কয়েকবার ভালো করে ধুয়ে নিলে তা শরীরের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর থাকে না। কারণ ফরমালিন পানিতে দ্রবীভূত হয় বলে কয়েকবার ধুলে ফরমালিনের ঘনত্ব খুবই কমে যায়। একই পদ্ধতি শাকসবজির বেলায়ও অনেকটা কার্যকর। শিশুদের কৃত্রিম রং ব্যবহার করে তৈরি খাদ্যদ্রব্য না খাওয়ানোর চেষ্টা করা। কারণ আমাদের দেশে বিবেকহীন কিছু মানুষ আছে, যারা পরিণতির কথা না ভেবেই কাপড়ের রং দিয়ে এসব খাবার বানায়। এর কারণ খাবারের রঙের দাম বেশি এবং কাপড়ের রঙের দাম তুলনামূলক অনেক কম। তাই পরিণতির কথা চিন্তা না করেই ভেজালকারীরা নিজের লাভ বাড়ানোর জন্য খাদ্যদ্রব্যে কাপড়ের রং ব্যবহার করে। অধিকাংশ মানুষই ক্ষতিকর দিক বিবেচনা না করে এসব খাবার গ্রহণ করে থাকেন। আবার অনেকের মধ্যে অগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতাও থাকে। কিন্তু এটি ক্রমেই ভয়াবহ পরিণতির দিকেই আমাদের টেনে নেবে। এ জন্য যে সামাজিক সচেতনতা থাকা প্রয়োজন, তা-ও আমাদের নেই। সামাজিকভাবে এ ধরনের অপকর্ম প্রতিরোধ করতে এবং মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা তাঁদের লেখায়, আলোচনায় এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এক সময় এই সমস্যাটি প্রকট রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং সচেতন জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রতিরোধের কারণেই তারা এই সমস্যাটি থেকে অনেকটাই মুক্ত।
আমাদের দেশেও এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা আইন প্রণয়নে যতটা আগ্রহী, আইন বাস্তবায়নে ততটাই উদাসীন। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া দেশের মানুষের অন্যতম সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সেই সাংবিধানিক অধিকার নাগরিকরা কতটুকু ভোগ করছে, তা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে তাকালেই বলে দেওয়া যায়। একইভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয়, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের সেই দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.