জীবনের সাইকেল-নো’ম চমস্কিকে খোলা চিঠি by মামুনুর রশীদ

প্রিয় চমস্কি, দুই দিন থেকেই ভাবছি, আমার অন্তরের এই ক্ষোভ কার কাছে প্রকাশ করব? অনেক ভেবেচিন্তে মনে হলো, আপনার কাছেই প্রকাশ করি। এডওয়ার্ড সাঈদ বেঁচে থাকলে তাঁর কাছেই হয়তো লিখতাম। আপনি নিশ্চয়ই জেনেছেন,
অবশেষে কাগুজে কামানটা দেগেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার হলে এক বক্তৃতায় অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, বিশ্বকে এখন নেতৃত্ব দেবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো। এ রকম বক্তৃতা আজ পর্যন্ত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট দিয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। বক্তৃতার মধ্যে ভারত ও চীনের পরাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনাকেও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। এই নাকচ করার মধ্যে তাঁর ভেতরের ভয়টিও প্রকাশ পেয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে বিজয়, ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা—এসব কৃতিত্বের কথাও তিনি উচ্চারণ করেছেন।
সবচেয়ে অর্থনৈতিক মন্দাগ্রস্ত ও ঋণে জর্জরিত রাষ্ট্রের প্রধান অস্ত্রের জোরেই পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে—এটাই বাস্তবতা। কিন্তু প্রাচ্যকে এভাবে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে অন্তসারশূন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটা বিলাপও লক্ষ করা গেছে। চীন, ভারত, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য, উপমহাদেশ ও আফ্রিকার দেশগুলোর প্রতি চরম অবজ্ঞাসূচক এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সভ্যতাবিধ্বংসকারী সাম্রাজ্যবাদী অহমিকাই প্রকাশ পেয়েছে।
যুদ্ধপ্রিয় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোই চিরদিন পৃথিবীতে অশান্তি ডেকে এনেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পশ্চিমেই শুরু হয়েছে। অথচ তার দায়ভার বহন করতে হয়েছে সারা বিশ্বকে। হিরোশিমা, নাগাসাকির প্রতিক্রিয়া আজও বিশ্বের আকাশে-বাতাসে। ভিয়েতনামের পরাজয়ের কথা নিশ্চয়ই মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। প্রাচ্যের শক্তি সম্পর্কেও তার ধারণা থাকা উচিত। চীন-ভারতের ক্রমবর্ধমান শক্তির ভয়েই কি আগ বাড়িয়ে কামানটা ফাটাল ওবামা?
নির্বাচনের আগে ওবামার বক্তৃতা শুনে মানুষের মনে ক্ষুদ্র হলেও একটা আশা জেগেছিল, সে হয়তো ভিন্নভাবে বিশ্বকে দেখবে। বিল ক্লিনটনের সময় সাময়িকভাবে হলেও একটু স্বস্তি পাওয়া গিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি উদ্যোগে তার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল। অভিবাসীদের মধ্যেও একটা আশার সঞ্চার করেছিল সে। ওবামা তো নিজের দেশের মন্দাকে একেবারেই মোকাবিলা করতে পারছে না।
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, মেধা-মনন বিকাশে প্রাচ্যের অবদান গগনচুম্বী। কয়েকটি সভ্যতার পাদপীঠ প্রাচ্য সংস্কৃতিতেও পৃথিবীর অগ্রপথিক। বারাক ওবামা মেধাবী ছাত্র ছিল, সে কি এডওয়ার্ড সাঈদের বই পড়েনি? না পড়লে তাকে আবার পড়তে বলবেন।
বুশ প্রশাসন ইরাকে কোনো বিজয় অর্জন করেনি, একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, মার্কিনদের চিরশত্রুতে পরিণত করেছে।
ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে একজন জঙ্গিকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতায় পরিণত করেছে, যা কারও কাঙ্ক্ষিত নয়।
প্রিয় চমস্কি,
আপনি প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক শক্তি সম্পর্কে জানেন। প্রাচ্যের বিপ্লব, প্রাচ্যের ভাবনা, প্রাচ্যের শান্তির অবতারদের সম্পর্কে আপনার গভীর জ্ঞান আছে। আমরাও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে অবাক হই। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ভূমিকা দেখেছি। সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান একবিংশ শতাব্দীর সূচনায় এ ধরনের দাম্ভিক, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য মন্তব্য করে কী করে? এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে একরোখা (arrogant) পশ্চিমাদের উসকে দিয়ে আরও অকারণ যুদ্ধ, রক্তপাতের সূচনা করল। গায়ের জোরে কি নেতৃত্ব হয়? নেতৃত্ব কী করে হয়, তা-ও আপনি জানেন।
এ ধরনের মন্তব্যের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল নেতৃত্বও জনস্বার্থ ভুলে গিয়ে পশ্চিমাদের পদপ্রান্তে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং দেশে দেশে তাদের দূতাবাসগুলো সার্বভৌমত্বের ওপর ছড়ি ঘোরাবে।
পৃথিবী আজ বিশ্বায়ন-আক্রান্ত। মানুষ আজ দিশেহারা। সীমাহীন বৈষম্য দেশে দেশে। সেই অবস্থায় পরিবর্তনের প্রবক্তা কি এইটুকু পরিবর্তনের কথা বলল? এই ছিল তার মনে? বর্ণবাদী, যুদ্ধবাজ শ্বেতাঙ্গ মার্কিন প্রশাসনের প্রধান এজেন্ডাটাই একজন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট দিয়েই কার্যকর করছে?
প্রিয় চমস্কি,
জানি, আপনিও আমাদের মতোই অসহায়। তবু আপনিই সহায়।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.