বিচারপতির 'গায়েবানা সংবর্ধনা'

রাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখা উচিত। সভ্য দুনিয়ার সব দেশেই তা করা হয়। কোনো দেশে এটি করা না হলে সে দেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়, স্থিতি নষ্ট হয় এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে। রাষ্ট্রের সেই অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিচার বিভাগ।

এ ছাড়া আছেন রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের দেশে অপরিণামদর্শী কিছু রাজনীতিবিদ ও তাঁদের আইনজীবী-সমর্থকরা সেই বিচার বিভাগকেই আজ বিতর্কিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত ও বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। প্রধান বিচারপতির কক্ষের দরজায় লাথি মারা, সর্বোচ্চ আদালতে মিছিল ও ভাঙচুর করা, বস্তিবাসী তথা বহিরাগতদের দিয়ে আদালত অঙ্গনে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা ও পদোন্নতি দেওয়া_এমন অনেক কিছুই ঘটেছে ইতিমধ্যে। সেই ঘটনামালায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বিদায়ী প্রধান বিচারপতির 'গায়েবানা সংবর্ধনা' এবং আদালত অঙ্গনে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ। আর একবার কোনো খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলে পরবর্তীকালে তা অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়। কাজেই এখন বিএনপি-সমর্থক প্রাজ্ঞ আইনজীবীরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতার পালাবদলের পর আওয়ামী লীগপন্থী প্রাজ্ঞ আইনজীবীরাও যে একই আত্মঘাতী রেওয়াজ অনুসরণ করবেন_সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
এ দেশের বিচার বিভাগকে ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র শুরু হয় অনেক আগে সামরিক শাসনামলের শুরু থেকে। স্বৈরশাসনকে পাকাপোক্ত করার জন্যই সে সময়ের স্বৈরশাসকরা তা করেছিলেন। আর তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট তকমাধারী কিছু সুযোগসন্ধানী আইনজীবী। তাঁদের কেউ কেউ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ উভয়ের সঙ্গেই প্রায় পুরো মেয়াদে কাজ করেছেন এবং সূক্ষ্মভাবে বিচার বিভাগ ধ্বংসের পথ দেখিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের কেউ কেউ এরশাদের লেজুড়বৃত্তি করার পরও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা জোট সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। তাঁদেরই পরামর্শে বিচার বিভাগের পায়ে কুড়াল মারার কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল। সে সময়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় একযোগে প্রায় দেড় ডজন অযোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা হয়েছিল। সেই বিচারকদের মধ্যে এমন বিচারকও ছিলেন, যাঁর আইন শিক্ষার সনদপত্রই ছিল ভুয়া। কমবেশি সেই ধারাই অব্যাহত আছে এখনো। জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের ডিঙিয়ে কনিষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ধারা তখনো ছিল, এখনো আছে। সম্ভবত ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু এসবের ফলে জনমনে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হচ্ছে, তাতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হবে। এখন বিএনপির নেতারা বলছেন, 'রায় মানি না', ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ নেতারা বলবেন, তারপর যাদের শক্তি ও ক্ষমতা আছে তারাই বলবে 'আমরা এ কলুষিত আদালতের রায় মানি না।' সেটি কি কোনো সভ্য দেশের জন্য কাম্য পরিস্থিতি হবে? নাকি আমরা নিজেদের অসভ্য দেশের তালিকায় বন্দি করে ফেলব?
ব্যারিস্টার ও নন-ব্যারিস্টার বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী এবং আইনজীবী, বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমরা অনুরোধ জানাই, বিচার বিভাগের মর্যাদাকে এভাবে ভূলুণ্ঠিত করবেন না। আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই স্বাধীন ও উচ্চ ভাবমূর্তিসম্পন্ন বিচার বিভাগ থাকাটা জরুরি। দেশের সচেতন প্রতিটি নাগরিকেরই এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.