নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে by ড. এ কে মনোওয়ার উদ্দীন আহমদ

মহৎ লক্ষ্য অর্জনে জনকল্যাণে রাজনৈতিক কর্মসূচি তথা রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন আমাদের সমাজে স্বীকৃত পদ্ধতি। চলমান অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সাধারণ গতিধারা এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা অবশ্যই এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলব।

গত দুই দশকে বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি বিবেকবান মানুষের মনে শঙ্কা ও উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির বিষয়টি একেবারে সম্পৃক্ত। অর্থনীতি রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দল হচ্ছে সরকারের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি একটি অনুমিত শর্ত। বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা কখনোই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। রাজনৈতিক নেতাদের জনগণের কাছে আছে এক সীমাহীন দায়িত্ব। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যেমন সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই, তেমনি অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা পুষ্ট করতে হলে অবশ্যই সুস্থ রাজনীতি অপরিহার্য। নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল্য জনগণকেই দিতে হয় এবং এ দেশে তো তা-ই হচ্ছে। এই মূল্য বা খেসারত শুধু রাজনৈতিক বা সামাজিক নয়। আমাদের প্রতিনিয়ত বড় ধরনের নেতিবাচক রাজনীতির অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমাদের অর্থনীতি পরনির্ভর, যা উন্নয়ন-অগ্রগতির বড় অন্তরায়। হরতালে কারখানার উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন ও আয় হয় নিম্নমুখী। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থবিরতা নেমে আসে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবদানের ক্ষেত্রে কর্মকাণ্ডগুলো বড় ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সমাজ, পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সদস্যদের জন্য এর অর্থনৈতিক তাৎপর্য অনেক গভীর। সমাজের সাধারণ নাগরিকদের এর ফলে নৈতিক সাহস দারুণভাবে হ্রাস পায়। জনমনে নেমে আসে চরম হতাশা। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শুধু তাই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যও হয় বাধাগ্রস্ত। রাষ্ট্রের এমন কোনো অর্থনৈতিক খাত নেই, যা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। দেশ ও জনগণকে দিতে হয় চরম মূল্য। কিন্তু এর বিনিময়ে তাঁরা অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের লাভ করে না বরং ক্ষতির দিকটা চরম স্ফীত হয়। এ খেলায় কোনো অর্থনৈতিক বা সামাজিক কল্যাণ নেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ-অবকাঠামোগত নানা সমস্যা বিদ্যমান এবং এসবও অর্থনীতির গতিপথে বাধা সৃষ্টি করছে। এসব নতুন করে বলার কিছু নেই। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধির হার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সারা বছরে যে পরিমাণ অপচয় হয়, তা যথাযথ সমীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করলে সুখকর চিত্র মেলা খুব ভার। আমাদের গতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এসবই বড় বাধা। দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগের পরিবেশকেও দারুণভাবে ব্যাহত করেছে। দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহ বোধ করছেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীল ও অর্থনৈকি পলিসির ধারাবাহিকতা বিনিয়োগের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এসব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চলেছে। এ বিস্ময়গুলোর রাজনৈতিক খেসারতই অনেক বড়। এখনই এই বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে না পারলে ক্ষতির দিক আরো স্ফীত হবে এবং জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংস হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন বাইরের রাজনীতির প্রভাবে আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি তথাকথিত দাতাগোষ্ঠীর কূটনীতিকদের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। তাঁরা এখন নগ্নভাবে বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছেন। আসলে আমরাই তাঁদের দাওয়াত করে এনেছি। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই এর জন্য দায়ী। শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তাঁরা সবক দেন। স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের জন্য এসব মর্যাদাকর নয়। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমরা অবশ্যই এটাকে বাধা দেব। বিদেশি ব্যবসায়ী বা বাণিজ্যিকগোষ্ঠী তথাকথিত দাতাগোষ্ঠী নামে আমাদের ঘরোয়া রাজনীতিতে শুধু উসকানি দিচ্ছে, অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। আজ যদি আমাদের অর্থনীতি স্বনির্ভর হতো, তাহলে এই অপক্রিয়া তারা চালাতে পারত না। তাদের এসব কাজের মূল্য দিতে জনগণ নারাজ। আমাদের জাতীয়তাবোধের স্পিরিট আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ করবে। তা না হলে আমরা দাঁড়াতে পারব না। আমাদের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করার চেষ্টা বা উদ্যোগ জোরদার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
গ্রন্থনা : দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

No comments

Powered by Blogger.