মূল রচনা-মিষ্টি দই, ইলিশ ও জয় বাংলা by মিজানুর রহমান খান

তিনি সবচেয়ে বেশি খেয়েছেন মিষ্টি দই। অনুরোধে রসমালাই খেয়েও তৃপ্ত হয়েছেন। খুব পছন্দের ছিল ইলিশ। কাঁটা বেছে খেতে পারেন না, তাই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল স্মোকড হিলশা। মাংস খেয়েও তারিফ করেছেন। চিবুতে সমস্যা, তাই একটু নরম করে রান্না করে দিয়েছিলেন রূপসী বাংলার রাঁধুনিরা।


মাছে-ভাতে বাঙালিও হয়েছেন। তিনি লে. জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকব।
বাংলাদেশের নৌবিহার তাঁর খুবই পছন্দের। তাই যখন ঢাকার কর্মসূচি শুনলেন তখন তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল, নৌবিহার আছে কি না। তবে পোস্তগোলা থেকে প্রমোদতরী যখন ছাড়ল তখন তাঁর নাসারন্ধ্রে দূষিত পানির গন্ধ। তিনি বললেন, নদীর এ কী হাল! দুপাশের নিসর্গ অবলোকন করে মুগ্ধ হলেও তাঁর নজর এড়ায়নি দুপাশের ইটের ভাটা। বললেন, পরিবেশের কী ক্ষতিই না হচ্ছে!
খুব আয়েশ করে লঞ্চের ডেকে বসেছিলেন। এর আগেও তিনি নদীমাতৃক বাংলার সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। তাঁর গভীরতম অনুরাগ একাত্তরের ১৩-১৬ ডিসেম্বরের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা, যার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা প্রগাঢ়। এতে কখনোই তিনি ক্লান্তিবোধ করেন না। ঢাকায় তাঁর ৭২ ঘণ্টার অবস্থানকালে ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে ছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএর শেষ বর্ষের ছাত্র জুনায়েদ নূর আলম।
জ্যাকবের সবচেয়ে প্রিয় বলার বিষয়, ফরাসি বিপ্লব এবং দ্য গল। দ্য গল কিভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করেছিলেন সেকথা তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রিয় সামরিক চরিত্র ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অধিনায়ক ও তাঁদের জাতীয় বীর অ্যাডমিরাল হোরাসিও লর্ড নেলসন (১৭৫৮-১৮০৫)। তিনি ফরাসিদের নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের অনুকূলে বিস্ময়কর সাফল্য বয়ে এনেছিলেন। ১৭৯৭ সালে সান্তা ক্রুজ দ্য টেনেরিফের যুদ্ধে তিনি ডান হাত হারান। তবে তাঁর খ্যাতি ছিল অন্য কারণে। তিনি যেসব বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন, তার নেপথ্যে ছিল তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রণকৌশলগত আদেশ সময়ে সময়ে অমান্য করা। এভাবেই ১৭৯৭ সালে স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে একটি বিজয় নিশ্চিত করেন। ভূমধ্যসাগরে কালভি যুদ্ধে নেলসন তাঁর ডান চোখ চিরতরে হারিয়েছিলেন। চোখ হারানো এই অ্যাডমিরাল নেলসন জেনারেল জ্যাকবের আদর্শ।
২৫ মার্চ রূপসী বাংলার বিজনেস সেন্টারে প্রথম আলো আয়োজিত অন্তরঙ্গ কথোপকথনে মশগুল হয়েছিলেন জ্যাকব। সঙ্গী তাঁর একাত্তরের কমরেড পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। ২০০ বছর আগের নেলসনকে অভিনয় করে দেখান ৯০ ছুঁইছুঁই জেনারেল জ্যাকব। নেলসনের প্রতি নির্দেশ ছিল তাঁর রণতরী সরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু তা তাঁর মনঃপূত ছিল না। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ফাঁকি দেন। দৃষ্টিহীন চোখে টেলিস্কোপ লাগিয়ে নেলসন বলেছিলেন, কই, আমি তো এ রকম কোনো সংকেত দেখতে পাইনি! লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ার, যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে উঠেছিল, সেখানে নেলসনের বীরোচিত আবক্ষ মূর্তি সহজেই নজর কাড়ে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মুখোমুখি বসেছিলেন জ্যাকব। তিনি নেলসনের মতোই টেলিস্কোপ লাগানোর ভঙ্গি করে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ওঁর স্টাইলেই একাত্তরে ঊর্ধ্বতন সেনানায়কদের নির্দেশ অমান্য করেছিলাম। তাঁরা বলেছিলেন, ঢাকাকে বাদ দিয়ে আগে সব বড় শহরের পতন ঘটাতে হবে। কিন্তু আমি তা করিনি। জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আমি আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছিলাম। ’
জ্যাকব এ জন্য গর্বিত। বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসায়, স্বীকৃতিতে তিনি মুগ্ধ। কিন্তু নিজের দেশ ভারতের কাছ থেকে তিনি স্বীকৃতি পাননি।
২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে জ্যাকব সবার হূদয় স্পর্শ করেন। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মাননা নিতে মঞ্চে ওঠেন তখন শুরু হয় করতালি। সেই তালি আর থামতেই চায় না। মুহুর্মুহু করতালিতে জেনারেল জ্যাকব নন্দিত ও সিক্ত হতে থাকেন। হল অব ফেমে অভ্যাগত প্রত্যেকে নিজ আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান।
কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এ সময় জয়বাংলা স্লোগান দিলে প্রতি-উত্তরে জ্যাকবও উঁচু লয়ে স্লোগান দেন ‘জয়বাংলা’। জুনায়েদ পরে আমাদের বলেছেন, এ সময় আবেগে উদ্বেলিত জে এফ আর জ্যাকব স্বগোতক্তি করেন, আমি কেন এই মহান দেশের নাগরিক হলাম না।
জ্যাকব ঢাকায় আরেকটি কথা বারবার গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন সেটি হলো, নতুন প্রজন্মকেই দেশ গঠনের দায়িত্ব নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.