মুক্তির সারথি by রাহীদ এজাজ

তাঁদের অনেকের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না বাংলাদেশের। অনেকে এমনকি কখনো পা মাড়াননি এ জনপদে। তার পরও ক্রান্তিকালে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের পরম বান্ধব। কেউ কেউ সন্ধিক্ষণের ত্রাতা। বিশ্ব মানচিত্রে লাল-সবুজ পতাকার অভ্যুদয়ে অগ্রণী সঙ্গী।


জাতি-ধর্ম-বর্ণ আর ভৌগোলিক সীমারেখার বেড়া ডিঙিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের এসব বন্ধু হাত বাড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি। তাঁদের এ সহযোগিতা ছিল প্রাণের তাগিদ থেকে।
বলছিলাম বাংলাদেশের সেই সব হূদয়বান ও আলোকিত বিদেশি বন্ধুর কথা, যাঁরা নিজেদের আলোয় বাংলাদেশকে উদ্ভাসিত করেছেন। চার দশক আগে এ দেশের জন্মলগ্নের সময়টাতে বাংলাদেশের পাশে ছিলেন। তাই বাংলাদেশ যখন বর্ণাঢ্য আয়োজনে এসব মানুষকে সম্মানিত করেছে, তখন তাঁরা গর্বিত হয়েছেন। এ দেশের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা বেড়েছে। অনেকেরই মনে হয়েছে, এমন দেশের জন্যই তো বারবার বুক পেতে দেওয়া যায়!
বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বন্ধুদের ভালোবাসা আর তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক উজ্জ্বল আবহ সৃষ্টি হয়েছিল গত ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। এদিন সকালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু হয়ে হাত বাড়ানো বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়া হয়। সম্মাননা গ্রহণের পর উপস্থিত এসব উজ্জ্বল মানুষ ও তাঁদের স্বজনেরা বাংলাদেশের প্রতি জানিয়েছেন শুভকামনা।
এদিন দুটি আলাদা শ্রেণীতে ৮২ ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্মাননা দেওয়া হয়। এদের মধ্যে আট ব্যক্তিকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ এবং ৭৪ ব্যক্তি ও সংগঠনকে দেওয়া হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’। প্রদান করা হয় কাঠের ওপর খোদাই করা জাতীয় স্মৃতিসৌধের একটি স্মারক ও মানপত্র।
এখানে বলে রাখা ভালো, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে প্রথম সম্মাননা দেওয়া হয় ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। গত বছরের ২৫ জুলাই তাঁকে দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’। ওইদিন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁর পুত্রবধূ ও কংগ্রেস পার্টির সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী।

সত্যি, বাংলাদেশই জানে!
একাত্তরে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড প্রতিনিয়ত কূটনৈতিক বার্তায় বাংলাদেশে গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন। শুভ-অশুভের লড়াইয়ের দিনগুলোতে ব্লাডের হূদয়বৃত্তির কাছে হার মেনেছিল কাটখোট্টা কূটনৈতিক পেশাদারি। তাইতো তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন আছে জেনেও বাংলার মুক্তিকামী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন আর্চার ব্লাড। প্রয়াত বাবা আর্চার কে ব্লাডের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী সম্মাননা গ্রহণটা তাই মেয়ে বারবারার কাছে ছিল যুগপৎ আবেগ, রোমাঞ্চ আর গৌরবের। গত মঙ্গলবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ব্লাড র‌্যানকিনকে গর্বিত করেছে, তেমনি ছড়িয়েছে মুগ্ধতার আবেশ। তিনি বললেন, বন্ধুদের এভাবে সম্মানিত করে একটি চমৎকার কাজ করেছে বাংলাদেশ। গত কয়েক দিনের আতিথেয়তায় আমাদের যেভাবে আপন করে নেওয়া হয়েছে, তার জুড়ি নেই। সত্যি, বাংলাদেশই জানে কীভাবে বন্ধুকে সম্মান জানাতে হয়।’

সম্মাননা থেকে বন্ধুতা
সম্মাননা অনুষ্ঠানটি বিদেশি বন্ধুদের সবাইকে মুগ্ধ করেছে, বাংলাদেশকে নিয়ে শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা বাড়িয়েছে। আবার সাবেক ব্রিটিশ এমপি মাইকেল বার্নস ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের মেয়ে নন্দিতা হাকসারের মতে, এ উদ্যোগ পৃথিবীর নানা প্রান্তে বাংলাদেশের বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে গড়ে তুলেছে মৈত্রীর বন্ধন। একদল নতুন বন্ধু পেয়েছে বাংলাদেশ। নন্দিতার ভাষায়: এটি সত্যিই এক আবেগঘন আয়োজন, একটি অর্থবহ অনুষ্ঠান। আমাদের কাছে পাঠানো নিমন্ত্রণের চিঠিতে চার দশক পর এ আয়োজনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছিল। আমি তো মনে করি, ৪০ বছর পরও বন্ধুদের মনে রেখে এ আয়োজন এক বিশেষ পাওয়াই বটে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আরেক দল নতুন বন্ধু পেল বাংলাদেশ।
মাইকেল বার্নস বলেন, ‘আমার তো জানাই ছিল না, কতজন কত বিচিত্রভাবে একাত্তরে বাংলাদেশের জন্য ব্রতী হয়েছিলেন। এ অনুষ্ঠানে না এলে এভাবে হয়তো আমাদের এবং আমাদের পরিবারের সদস্যদের জানা হতো না, সেই দিনগুলোতে আমরা কীভাবে হাতে হাত রেখেছিলাম। একে অন্যের ভূমিকার কথা শুনেছি আর শিহরিত হয়েছি। আর এ কদিনে বাংলাদেশের বন্ধুরা হয়ে উঠেছি একে অন্যের পরম আপনজন। ধন্যবাদ বাংলাদেশ।

ঠাঁই হোক মোর এ মাটি জলে
মার্কিন মানবাধিকার কর্মী ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিমের আরেকটি কাজ ছিল শিক্ষার আলো জ্বালানো। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে একসঙ্গে দুই ভূমিকায় সক্রিয় ছিলেন টিম। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় প্রতিদিন নানাভাবে সহায়তা করতেন তিনি। পাশাপাশি বাংলাদেশের গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের তথ্য বিদেশে পাঠিয়ে জনমত গঠনে সক্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার চার দশক পর এ দেশ নিয়ে আপ্লুত টিম মৃত্যুর পর মিশে যেতে চান বাংলার মাটিতে। সম্মাননা শেষে কারণ জানতে চেয়েছিলাম। টিমের উত্তর: ‘একাত্তরে যখন মনপুরা, হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় পা রাখি, তখন বয়স ২০ ছাড়িয়েছে। সেই থেকে দীর্ঘ সময় ধরে মেলামেশার পর এ দেশের মানুষের প্রতি বিশেষ করে, গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলো আমায় টেনেছে। মুগ্ধ হয়েছি তাদের সরলতায়। তাদের জন্য যতটা করা হয়, প্রতিদান তারা দেয় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। মৃত্যুর পর এমন দেশের মাটিতে ঠাঁই নিতে চাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়!’
জাপানের সাবেক আইনসভার সদস্য ও সমাজসেবী তাকাশি হায়াকাওয়া প্রথম পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবলে বিপর্যস্ত এ জনপদ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। বিশেষ করে, প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাকের দিক থেকে নিজের দেশ জাপানের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। তাই একাত্তরে বীর বাঙালি যখন অস্ত্র ধরল, সক্রিয় হলেন তাকাশি হায়াকাওয়াও। বাঙালি নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পাশাপাশি গলায় ঝুড়ি বেঁধে বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যার্থে টাকা, খাবার ও ওষুধ সংগ্রহ করেছেন। আমার বাংলাদেশ নামে তাকাশি হায়াকাওয়ার বই বাংলায় প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। বাবার ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে ওসামু হাইয়াকাওয়ার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের পর বাবাকে নিয়ে তিনবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। এর মাঝে প্রথমবার বাহাত্তরে এসে দেখা মিলেছিল বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর। সম্মাননা নিতে এসে কি বিশেষ কিছু ফিরে এল! বিশেষ কিছু তো বটেই! তবে সেটি গত বছরের একটি ঘটনা। ভূমিকম্পের পর সুনামির তাণ্ডবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে জাপানে। ইতিহাসের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরপরই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। পাঠানো হয় জরুরি মানবিক সাহায্য। গর্বে সেদিন ভরে গিয়েছিল ওসামুর বুকটা। এই তো সেই বাংলাদেশ, যার স্বপ্নপূরণের সারথি ছিলেন তাঁর বাবাও।

No comments

Powered by Blogger.