দুর্নীতি ও প্রযুক্তি-ভারতে টু-জি কেলেঙ্কারি ও বাংলাদেশ by জাকারিয়া স্বপন

বাংলাদেশ চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানি (গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক এবং সিটিসেল) লাইসেন্স নবায়ন করতে যাচ্ছে। তাদের এই লাইসেন্স হলো ২-জি (ইংরেজিতে টু-জি) ফ্রিকোয়েন্সির লাইসেন্স। এই নভেম্বর মাসে তাদের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তাই এর ভেতরই লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।


প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রতি মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি ৮০০ ব্যান্ডে ৩০০ কোটি টাকা এবং ১৯০০ ব্যান্ডে ১৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু পরে টেলিকম অপারেটরদের চাপের মুখে সেটা কমিয়ে ৮০০ ও ১৯০০ উভয় ব্যান্ডেই জিএসএম প্রযুক্তির জন্য ১৫০ কোটি টাকা ও সিডিএমএর (সিটিসেল) জন্য ৮০ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে। পাশাপাশি থ্রি-জির লাইসেন্স উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে বলে জানানো হয়েছে এবং এটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। বাংলাদেশে মোবাইল কোম্পানিগুলোর এই লাইসেন্স নবায়ন ফি এবং নতুন থ্রি-জি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে, ভারতের টেলিকম কেলেঙ্কারি ঘটনাটি একটু বিশদ জেনে নেওয়া যাক। তাহলে পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হবে, কেন এই বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যান্য দেশে সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
এটি হলো ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা। বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে যে, ভারতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের যথার্থ মূল্যের কম দামে টু-জি ফ্রিকোয়েন্সি দেওয়া হয়েছে। ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) তার প্রতিবেদনে বলেছেন, এর ফলে রাষ্ট্রের ১৭৬,৩৭৯ কোটি রুপি (৩৮.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এটা হলো ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় অঙ্কের ক্ষতি। পাঠকরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, লাইসেন্সের একটু এদিক-সেদিকের কারণে কত হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্র হারাতে পারে। এ টাকা অন্যান্য যাবতীয় উপায়ে রাজস্ব আদায়ের চেয়েও বেশি হতে পারে।
যদিও লাইসেন্সগুলো দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে, কিন্তু এটা জনগণের সামনে আসে ২০১০ সালে, যখন ভারতের ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ নীরা রাদিয়া নামের একজন রাজনৈতিক লবিস্টের আয় তদন্তে নামে এবং পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট এই সংক্রান্ত একটি কেসের শুনানি শুরু করে। আয়কর বিভাগ নীরা রাদিয়ার টেলিফোনের কথা গোপনে রেকর্ড করতে শুরু করে। সন্দেহ করা হয়েছিল যে, নীরা রাদিয়া একজন গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছিলেন। প্রায় ৩০০ দিন ধরে টেলিফোন রেকর্ড করা হয় এবং সেগুলো মিডিয়াতে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং করপোরেট হাউসের বিভিন্ন ব্যক্তির উত্তপ্ত আলাপচারিতা প্রকাশ পেয়ে যায়।
বিখ্যাত যারা এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন
এ. রাজা : সাবেক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। তার সময়েই টু-জি ফ্রিকোয়েন্সির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল এবং জনগণের প্রতিবাদের মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
অরুণ সুরী : পূর্ববর্তী বিজেপি সরকারের সময় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। তিনি মূলত কন্ট্রভার্সিয়াল 'ইউনিফাইড এক্সেস লাইসেন্স' প্রবর্তন করেছিলেন। এর ফলে ফিক্সড টেলিফোন অপারেটররা মোবাইল ফোন সেবা দিতে পেরেছিল। রিলায়েন্স এবং টাটা_ এই দুটি কোম্পানি এটার সুবিধা পেয়েছিল। তারা নামমাত্র মূল্যে মোবাইল ফোন লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছিল।
প্রমোদ মহাজন : ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। তার সময়েই বিজেপি সরকার 'লাইসেন্স ফি' মডেলকে বাতিল করে 'রেভিনিউ শেয়ারিং' মডেল চালু করে, যা রাজনীতিবিদসহ টেলিকম বিশেষজ্ঞরা এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বিরোধিতা করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারত রাষ্ট্র ৬৪ হাজার কোটি রুপি (১৩.৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) লোকসান করেছে।
পরে টেলিকম মন্ত্রী এ. রাজা নিজেকে এই বলে নির্দোষ দাবি করেন যে, বিজেপি সরকার যে নিয়ম করে রেখে গিয়েছিল, তিনি সেই ভিত্তিতেই নতুন লাইসেন্স দিয়েছেন। প্রমোদ মহাজনের সঙ্গে বড় শিল্পপতিদের খুব দহরম ছিল এবং এই লাইসেন্স প্রক্রিয়া পরিবর্তনের ঠিক আগের দিন তাকে সরিয়ে জাগমোহনকে টেলিকম মন্ত্রী করা হয়। এর ফলে রিলায়েন্স গ্রুপ সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। পরে এটা বেরিয়ে আসে যে, প্রমোদ মহাজন এবং তার কিছু কাছের মানুষ বেনামিতে রিলায়েন্সের বিরাট অঙ্কের শেয়ার পেয়েছিলেন।
সিদ্ধার্থ বেহুরা : টু-জি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন টেলিকম সেক্রেটারিকে।
প্রদীপ বাইজাল : ভারতের তৎকালীন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের প্রধান।
নীরা রাদিয়া : এন্টারপ্রেনর ও লবিস্ট, যার টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছিল।
বারখা দত্ত : এনডিটিভির সাংবাদিক, যিনি লবিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন।
ভির সাংভী : হিন্দুস্তান টাইমসের সম্পাদক, যিনি প্রতিনিয়ত সংবাদগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
যত টাকার ঘাপলা :তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী এ. রাজা টু-জির ফ্রিকোয়েন্সির বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করে দেন। সোয়ান টেলিকম নামের একটি নতুন কোম্পানি মাত্র এক হাজার ৫৩৭ কোটি রুপি দিয়ে লাইসেন্স কেনে এবং কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানিটি তাদের ৪৫% শেয়ার দুবাইয়ের ইতিসালাত কোম্পানির কাছে ৪ হাজার ২০০ কোটি রুপিতে বিক্রি করে দেয়।
একইভাবে ইউনিটেক গ্রুপ এক হাজার ৬৬১ কোটি টাকা দিয়ে লাইসেন্স কেনে, কিছুদিনের মধ্যেই তারা ৬০% শেয়ার বিখ্যাত টেলিনরের কাছে (বাংলাদেশে গ্রামীণফোনের শেয়ারহোল্ডার) ৬ হাজার ২০০ কোটি রুপিতে বিক্রি করে দেয়।
টেলিকম নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারের লাইসেন্স বিক্রি করার কথা বাজারদর অনুযায়ী। যেহেতু এই দুটি কোম্পানি লাইসেন্স পাওয়ার পরপরই অনেক চড়া দামে বাইরের কোম্পানির কাছে শেয়ার বিক্রি করেছে, তার অর্থ হলো মূল লাইসেন্সটি অনেক কম দামে তারা পেয়েছিল। সরকার সঠিক মূল্যে লাইসেন্স বিক্রি করেনি।
নয়টি কোম্পানি টু-জির লাইসেন্স কিনেছিল, যারা সম্মিলিতভাবে ১০ হাজার ৭৭২ কোটি রুপি (২.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সরকারকে দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত বাজরদর হিসেবে সেই লাইসেন্সের মূল্য হওয়া উচিত ছিল ১৭৬,৭০০ কোটি রুপি (৩৮.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
ঘটনাপ্রবাহ :২০০৮ সাল থেকেই এই ক্ষতি নিয়ে কথা চলতে থাকে। বিভিন্ন মহলে এটা নিয়ে তোলপাড় হতে থাকে যে, এই লাইসেন্স প্রক্রিয়ার ফলে ভারত সরকারের প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার সেটা মানছিল না। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন যে, তার টেলিকমমন্ত্রী এ. রাজা যা করেছে তা ঠিকই করেছে, কোনো রকম দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি।
২০১০ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে জয়ললিতা তামিলনাড়ূর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এম. করুণানিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, তিনি টেলিকমমন্ত্রী এ. রাজাকে প্রটেকশন দিচ্ছেন এবং জয়ললিতা টেলিকমমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। মধ্য নভেম্বরে মি. রাজা পদত্যাগ করেন।
মধ্য নভেম্বরে ভারতের কম্পট্রোলার বিনোদ রাই লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন এই বলে যে, তারা যখন লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল তখন তাদের কাছে নিয়মানুযায়ী তহবিল ছিল না, যা আইনবহির্ভূত। ফলে তাদের লাইসেন্স আইনসিদ্ধ নয়। তবে ধারণা করা হয় যে, যেহেতু এসব টেলিফোন কোম্পানির গ্রাহক রয়েছে তাই তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না; তবে জরিমানা করা হবে।
এটা নিয়ে ভারতের সংসদেও প্রচুর বাকবিতণ্ডা চলে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ. রাজা এবং অন্য ব্যক্তিদের পুলিশ গ্রেফতার করে। বিচার কাজ এখনও চলছে।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ :বাংলাদেশের চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানিকে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এই লাইসেন্সগুলো টু-জি নেটওয়ার্কের জন্য। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ কমিশন যে ফি প্রস্তাব করেছিল, সেটা থেকে ফি কমানো হয়েছে এবং কোনো রকম উন্মুক্ত টেন্ডার করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশ কোনো আয়ের ক্ষতি হয়েছে কি-না, সেটা খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে।

জাকারিয়া স্বপন :প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
zs@priyo.com
 

No comments

Powered by Blogger.