আন্না হাজারের আন্দোলন-মানব সমাজের বাতিঘর

ভারতে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে গান্ধীবাদী সমাজকর্মী আন্না হাজারের গুরুত্বপূর্ণ জয় অর্জিত হয়েছে। আন্না হাজারে যথার্থ বলেছেন, এ বিজয় তার নয়, ভারতবাসীর বিজয়। শনিবার লোকসভায় দুর্নীতিবিরোধী লোকপাল বিল নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের পর তার দাবি নীতিগতভাবে মেনে নেওয়া হয় এবং তিনি টানা ১২ দিনের অনশন প্রত্যাহারে সম্মত


হন। বিভিন্ন সরকারের আমলে জনপ্রতিনিধিরা যে বিলটি পাসে চার দশক ধরে অনীহা প্রদর্শন করে আসছিলেন, শেষ পর্যন্ত আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ সংস্থা লোকসভা সেই জনমতের চাপেই নতিস্বীকার করতে বাধ্য হলো। অনশন আন্দোলনের কাছে মাথানত করে আইন প্রণয়নে কার্যকর পদক্ষেপের নজির ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। একই সঙ্গে বলা যায়, এ ঘটনায় ভারতীয় গণতন্ত্র এক কঠিন পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী পক্ষের সহযোগিতা বিরল নয়। কিন্তু লোকপাল বিল ইস্যুতে আন্না হাজারের দাবি মেনে নেওয়া হলে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে বলে কোনো কোনো মহল থেকে অভিমত দেওয়া হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের নমনীয় অবস্থানের কারণে সংকটের সুরাহা হয়। আন্না হাজারে যথার্থই বলেছেন, এ ঘটনায় প্রকৃত জয় হয়েছে গণতন্ত্র ও জনগণের। তিনি ভারতীয় রাজনীতি কিংবা সমাজের অতিমাত্রায় প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি নন। কর্মজীবনের শুরুতে ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন গাড়িচালক। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণ করে চলেছেন বরাবর। কর্মপন্থাতেও অকৃত্রিম গান্ধীবাদী। তিনি দুর্নীতি নির্মূলে শাসকদের ব্যর্থতাকে ইস্যু করেছেন। ভারতের ১২০ কোটি নাগরিক সবাই অনশনে শামিল হয়নি, কিংবা দিলি্লর রামলীলা ময়দানে তার প্রতি সমর্থন প্রকাশেও হাজির থাকেনি। তবে দুর্নীতি নামের যে কালান্তক ব্যাধি নিরাময়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়নের দাবি তিনি করেছেন এবং কোটি কোটি নারী-পুরুষ মনে করেছে যে, এটা তাদেরও অন্তরের কথা। বিশেষভাবে তার আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের সমর্থন ছিল লক্ষণীয়। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগিয়ে চলা দেশটিতে একের পর এক বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা তাদের ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করেছে এবং আন্না হাজারের কর্মকাণ্ডে তারা খুঁজে পেয়েছে মুক্তির নিশানা। সে দেশের রাজনীতিকরাও আমজনতার দিক থেকে দেওয়া বার্তা শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং লোকসভায় সমঝোতায় উপনীত হয়ে তার প্রতি মর্যাদা দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিকরা এ ঘটনা থেকে একাধিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। প্রথমত, ভারতের মতো আমাদের দেশেও দুর্নীতি গুরুতর সমস্যা। এটা কমবেশি সবাই স্বীকার করেন যে, এ ব্যাধি থেকে নিষ্কৃতি মিললে উন্নয়নের গতি অনেক বেড়ে যাবে। এখানের জনমতও প্রবলভাবেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সে বার্তা অবশ্যই তাদের উপলব্ধি করা চাই। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের গুরুতর জাতীয় সমস্যার মোকাবেলায় জাতীয় সংসদের ভূমিকার বিকল্প নেই। ভারতের লোকসভায় দলমত নির্বিশেষে দুর্নীতি মোকাবেলায় ঐকমত্য হয়েছে। সেখানে রাতারাতি সবকিছু বদলে যাবে, এটা আশা করা যায় না। কিন্তু জনতার শক্তিকে একেবারে উপেক্ষা করে চলাও অসম্ভব। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যখন যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা পারতপক্ষে সংসদমুখী হন না এবং সরকার পক্ষও ভিন্নমতকে গুরুত্ব প্রদানে তেমন আগ্রহ দেখায় না। দেশের সার্বিক বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধভিত্তিক একটি সমাজ নির্মাণ করতে হলে এ ছাড়া বিকল্পও তো নেই। আন্না হাজারে বিশ্বের সর্বত্র দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শুধু ভারতে নয়, মানব সমাজের বাতিঘর এবং এর প্রভাব সর্বত্রই পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
 

No comments

Powered by Blogger.