শনিবারের সুসংবাদ-একজন রশিদ মাস্টার by আহসান হাবিব

পিচঢালা পথ শেষে আট কিলোমিটার মেঠোপথ ও মরা পদ্মা নদী পেরিয়ে তারাপুর গ্রাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এই গ্রামেই মানুষটির জন্ম। এখান থেকেই শুরু তাঁর জনসেবা। আর্থিক সংগতি নেই। গ্রামের বাইরে পরিচিতিও সামান্য।


তবে এসব প্রতিবন্ধকতা তাঁর শুভ উদ্যোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। 'জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/আরো যদি জোটে একটি পয়সা, দান করিও হে অনুরাগী' কবিতার পঙ্তি দুটি মানুষটির জীবনের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।
সমাজে কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের আজীবনের ব্রতই হয়ে ওঠে মানুষের সেবা করা। তাঁদেরই একজন তারাপুরের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান আবদুর রশিদ। জন্ম ১৯৪৫ সালে। নানা প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে আইএ পাস করেন। ১৯৮১ সালে পেশা হিসেবে বেছে নেন পল্লী চিকিৎসকের পেশা। এতে যে আয় হয়, তাতে কোনো রকমে নিজের সংসারের খরচটা চলে যায়। এই আর্থিক দৈন্যের মাঝেই ডা. আবদুর রশিদ দায়িত্ব নেন গ্রামের গরিব শিশু-কিশোরদের শিক্ষাদানের। ১৯৯১ সালে সেই যে শুরু, আর পিছপা হননি। নিজ বাড়ি ও বাজারে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নিজ উদ্যোগে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে ডা. আবদুর রশিদ শিক্ষাদান করে চলেছেন। এতিমখানা, গোরস্তান তৈরিসহ অন্যান্য সামাজিক কাজেও তিনি রেখে চলেছেন অসামান্য অবদান। চরম দারিদ্র্যের কারণে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ পায় না, তারাই শরণাপন্ন হয় পল্লী চিকিৎসক আবদুর রশিদের। আর এই মানুষটি বিশেষ যত্নে শিক্ষার আলোয় তাদের আলোকিত করে চলেছেন।
ডা. আবদুর রশিদ বিগত কয়েক বছরে তাঁর এই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা চেয়ে অনেকের কাছেই আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু সাড়া পাননি। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় এ পর্যন্ত এলাকার গরিব পরিবারের প্রায় দুই হাজার ছেলেমেয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছে। কাজ ও দারিদ্র্যের কারণে যারা স্কুলে যেতে পারে না তারা সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যার পর আবদুর রাশিদের বাড়িতে পড়াশোনা করতে যায়। সপ্তাহে দুদিন হাটবার ও বিশেষ দিন ছাড়া লেখাপড়া বন্ধ হয়নি এ পর্যন্ত।
আবদুর রশিদ নিজ বাড়িতে সকালে ও স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিকেলে এবং রাতে নৈশ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন প্রায় ১৮ বছর ধরে। প্রথমে সাহাপাড়া বাজারে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাদান কার্যক্রম। অনেক শিশু-কিশোর কাজ ও রোজগারের কারণে স্কুলে যেতে পারে না। আবার অনেকের বয়স কিছুটা বেশি। এদের প্রায় সবাই যায় ডা. আবদুর রশিদের কাছে শিক্ষালাভ করতে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। প্রয়োজন দেখা দেয় একটু জায়গা, ঘর, শিক্ষা উপকরণ এবং আরো দু-একজন সহকারী শিক্ষক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আবদুর রশিদের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে তিনটি ব্যাচে ১৩৫ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। প্রতিবছর ৬৫-৭০ জন ছাত্রছাত্রী প্রথম শ্রেণী থেকে লেখাপড়া শুরু করে। প্রথম ব্যাচটি তাঁর নিজ বাড়ির বারান্দায় দুপুরে, দ্বিতীয় ব্যাচটি স্থানীয় একটি মাদ্রাসা চত্বরের মেঝেতে বিকেলে এবং তৃতীয় ব্যাচটি বসে একই স্থানে সন্ধ্যার পর। আবদুর রশিদের নিজ খরচে কেরোসিনের প্রদীপের আলোয় চলে এই পাঠদান পর্ব।
আবদুর রশিদ বলেন, 'অভাবের কারণে আইএ পাস করার পর লেখাপড়া করতে পারিনি। এ অনুভূতি থেকেই অভাবীরা যাতে নিরক্ষর থেকে না যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে নিজ খরচে আমার এই উদ্যোগ। শুরু থেকেই বিদ্যালয় চালনা, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, প্রদীপের তেল খরচ, বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান চালিয়ে আসছি। এ পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা পাইনি। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বোঝাটা বুঝি বেশ ভারী হয়ে উঠছে। বাইরে থেকে সহায়তা না পেলে এই গণশিক্ষামূলক কর্মসূচিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।'
জনহিতৈষী মানুষটি জানালেন, তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনিই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই মাস ধরে অসুস্থ। আয়-রোজগারও কমে গেছে। নিজের সংসার চালানো ও চিকিৎসার ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। অর্থাভাবে নিজের নূ্যনতম চিকিৎসাটাও করতে পারছেন না। তার পরও শিক্ষাদান কার্যক্রম থেমে নেই।
স্থানীয় সাহাপাড়া পিএম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক সফিকুল ইসলাম ও মনাকষা ইউপির ওয়ার্ড সদস্য সমির উদ্দিন জানান, শিক্ষাদান সেবামূলক কাজ ছাড়াও ২০-২২ বছর থেকে ডা. আবদুর রশিদ এলাকায় গোরস্তান তৈরি, এতিমখানা নির্মাণ ছাড়াও এলাকার বিরোধপূর্ণ ঘটনা সালিসি সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানের মতো বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.