গণমাধ্যম-যৌবনের স্বপ্ন হারিয়ে গেল by পল্লব মোহাইমেন

২৯ মার্চ, সন্ধ্যা। আনিস ভাইয়ের (আনিসুল হক) ফোন, ‘পল্লব, মিনার মাহমুদের মৃতদেহ রিজেন্সি হোটেলে পাওয়া গেছে। নিউজকে বলো গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে।’ থমকে যাই। আমাদের যৌবনের শুরুতে দ্রোহের আগুন জ্বালানো সাংবাদিক মিনার মাহমুদ বেঁচে নেই। যেন দ্রোহের মৃত্যু হয়েছে প্রচণ্ড অভিমানের কাছে।


১৯৮৭ সাল। সরিষাবাড়ী কলেজে পড়ি তখন। মফস্বল শহরে থেকে চেষ্টা করি সব ধরনের পত্রপত্রিকা পড়ার। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানীর সঙ্গে পরিচয় আরও অনেক আগে থেকে। এরপর যায়যায়দিন, পূর্বাভাস। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের রোষানলে পড়ে দুটি পত্রিকাই বন্ধ তখন। এরই মধ্যে বিজ্ঞাপন—আসছে বিচিন্তা। নামই তো আলাদা। সম্পাদনা করবেন মিনার মাহমুদ। বিচিত্রায় অনেকগুলো সাড়া জাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করে তিনি তখন তুমুল আলোচিত।
নামে যেমন ভিন্নতা, পত্রিকার লেখা, বিষয়বস্তুতেও টগবগে একটা ভাব। সম্পাদক ছাড়া আর সব সাংবাদিকই আনকোরা। প্রচ্ছদ শিল্পী মাসুক হেলাল। তরুণ ফজলুল বারী তখন পায়ে হেঁটে সারা বাংলাদেশ ঘুরে ফেলেছেন। বিচিন্তায় সেই ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকে। আমরা গোগ্রাসে গিলি। যেখানে বাংলার বিভিন্ন জনপদের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা উঠে আসে। মনে আছে, আমি ও আমার সহপাঠী রোবায়েত ফেরদৌস অপেক্ষা করতাম কখন বিচিন্তা হাতে আসবে। মিনার মাহমুদের লেখা আমাদের মধ্যে সাংবাদিকতা করার অনুপ্রেরণা জোগায়। তাঁর কাটা কাটা বাক্য, ঝরঝরে অকপট লেখা পড়ে দ্রোহের আগুনের আঁচ পাই। সাহস করে দুবার দুটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম বিচিন্তায়। দ্বিতীয়টা ছাপা হয়েছিল। প্রথমটা ছাপা হয়নি, বদলে পেয়েছিলাম একটা পোস্টকার্ড। তাতে উৎসাহব্যঞ্জক কথা লেখা, নিচে মিনার মাহমুদের সই, বলপেনে দেওয়া। সেই পোস্টকার্ড পেয়ে মনে হচ্ছিল তিনি আমার কত কাছের, কত আপন।
বিচিন্তার জনপ্রিয়তা হু হু করে বেড়ে যায়। জনপ্রিয়তার পাশপাশি পাল্লা দিয়ে স্বৈরাচারের রোষ বেড়েছিল বিচিন্তার ওপর। ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কারাগারে যান মিনার মাহমুদ।
’৮৮-এর শেষভাগে চলে আসি ঢাকায়। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন চূড়ান্ত দিকে যাচ্ছে। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান, এরশাদের পতন দেখি ঢাকা শহরে বসেই। ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে বিচিন্তা আবারও বের হয় মগবাজারের সেই দিলু রোড থেকে। মিনার মাহমুদ এবারও নতুন দল নিয়ে কাজ শুরু করেন। আগের দলের দু-একজন ছিলেন হয়তো। গণতান্ত্রিক আমলে শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে করা এক প্রচ্ছদ প্রতিবেদন নিয়ে বিপাকে পড়েন। ওই সংখ্যাটা নিষিদ্ধ হয়। একদিন যাই বিচিন্তা অফিসে। মিনার মাহমুদের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা হয়। চিরদিনের জন্য চেতনায় গেঁথে যান মিনার মাহমুদ। দ্বিতীয় যাত্রায় বিচিন্তা নিয়ে আগের মতো সফলতা পাননি। বিচিন্তার প্রকাশনার দায়িত্ব দেন ইউএনবি ঢাকা কুরিয়ার গ্রুপের কাছে, অফিস চলে যায় কসমস সেন্টারে। বিচিন্তার প্রচ্ছদ ও শেষ পৃষ্ঠা তখন সাদা কাগজে ছাপা হতে থাকে। সেই বিচিন্তা আর আমাদের টানেনি। একদিন তার প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। মিনার মাহমুদ চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
’৯১ সালের নভেম্বরে ফজলুল বারী বের করেন সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম। এই পত্রিকায় শুরু থেকেই কাজ করতে থাকি। মিনার মাহমুদের সাবেক সহকর্মীদের অনেকেই সেখানে কাজ করেন। তাঁদের কাছে খবর নিই তাঁর। কেন নেই তা জানি না, কিন্তু সব সময় এই মানুষটিকে মনে হয় অনমনীয় তারুণ্যের প্রতীক। সব সাংবাদিকের খবর পাওয়া যায় আলোকচিত্রী আক্কাস মাহমুদের কাছে। আক্কাস ভাইকে জিজ্ঞেস করি, মিনার ভাই নিউইয়র্কে কী করেন? ‘ট্যাক্সি চালান।’ নিউইয়র্ক-ফেরত অনেকেই জানান, উনি শুধু ট্যাক্সিই চালান, আর নিজের মতো করে নিজের মধ্যে থাকেন।
১৮ বছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসেন মিনার মাহমুদ। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে অগ্রজ বন্ধু রেজা সেলিমের আমাদের গ্রাম প্রকল্পের জ্ঞান মেলায় যাওয়ার সময় মিনার মাহমুদের সঙ্গে এক গাড়িতে যাই মাওয়া পর্যন্ত। কথা বলে বুঝতে পারি আবারও তিনি স্বপ্ন দেখছেন। বন্ধুদের সহায়তায় বিচিন্তার মালিকানাও ফিরে পেতে যাচ্ছেন। আবারও তিনি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আগুন জ্বালাতে চান, স্বপ্ন দেখাতে চান। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ কী হবে, সে ব্যাপারে যদিও খুব একটা নিশ্চিত নন। এর পর থেকে মোটামুটি যোগাযোগ হতো মিনার মাহমুদের সঙ্গে। খুলনায় আরও একবার দেখা হয় মিনার মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী ডা. লাজুকের সঙ্গেও।
২০১০ সালের অক্টোবরে আহসানুল হাকিমকে নিয়ে বিচিন্তার তৃতীয় যাত্রা শুরু করেন। আক্কাস মাহমুদ প্রতিটি সংখ্যা পাঠাতেন পড়ার জন্য। ২০ বছরে দেশের প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। স্বৈরশাসন নেই। পত্রিকাজগৎ, পাঠক—সবকিছুই এখন ভিন্নতর। মিনার মাহমুদের তেজ কিন্তু আগের মতোই। তিনি করপোরেট বা বহুজাতিক বিজ্ঞাপন নেবেন না। তাই তৃতীয় বিচিন্তা আর্থিক অনটনে। পাঠকপ্রিয়তাও আগের মতো নয়। বিচিন্তা আবার বন্ধ। স্বপ্নবান এক নায়ক ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকেন হতাশার চোরাবালিতে।
শুক্রবার ফোনে রেজা সেলিমের সঙ্গে কথা হয়। বলি, সেলিম ভাই আপনারা বন্ধুরা কিছু বুঝতে পারেননি? বলেন, ‘হতাশা যে এ পর্যায়ে গেছে তা কখনো বুঝতে দেয়নি মিনার। সেই সময়ে সফলতার শিখরে ছিল। এখনকার প্রেক্ষাপটে সেই সাফল্য আসেনি। এটা হয়তো সে মেনে নিতে পারেনি।’ মিনার মাহমুদের ভাই মেহেদি হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর ভাই বাংলাদেশের গণমাধ্যম দাঁড় করাতে অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু এখন সেখানে তাঁর স্থান হয়নি।
মিনার মাহমুদের মৃত্যু শুধু তুখোড় এক সাংবাদিকের মৃত্যু নয়, এ এক স্বপ্নের হারিয়ে যাওয়া। প্রচণ্ড অভিমানে চলে যাওয়া। স্রোতে গা ভাসিয়ে হয়তো নিজের স্বপ্নকে বন্দরে নোঙর করাতে পারতেন। কিন্তু মিনার মাহমুদ তো আর সেই মানুষ না। নিজের যন্ত্রণা নিজের মধ্যে রেখে নিজেই বিদায় নিলেন। তবে একটা কষ্ট আমার বুকে থেকেই যাবে। যে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপে আমাদের যৌবন শাণিত হয়েছে, সেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার। আর অনেকের যৌবনকালের সেনাপতি মিনার মাহমুদের যথাযথ স্থান হলো না কোথাও। চলে যেতে হলো একবুক অভিমান নিয়ে। একজন মিনার মাহমুদের মধ্যে যে কী পরিমাণ স্বপ্ন, উদ্দীপনা থাকতে পারে তা জানতে পারল না এ প্রজন্মের তারুণ্য।
 পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক।
pallabmohaimen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.