ওসামা হত্যা-আরব ও পাশ্চাত্যের সম্পর্কের হেমন্তকাল by তারিক রামাদান

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু ঘোষণার পর প্রথম সপ্তাহের প্রতিক্রিয়ায় নানা বিষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। সংবাদটির প্রতীকী অভিঘাত পাশ্চাত্যে মিডিয়া উন্মাদনার সূত্রপাত ঘটায়। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজ ও গ্লোবাল সাউথ জুড়ে প্রচারিত হয়েছে অনেকটাই মাপা, যেন আমরা একই সঙ্গে দুনিয়ার দুটি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত দেখছিলাম।


আল-কায়েদা অথবা যেকোনো ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ব্যবহূত শব্দমালা বা অলংকার কখনোই বিশ্বের মুসলমানেরা গ্রহণ করেনি। স্বাধীনভাবে পরিচালিত অল্প কয়েক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে বিবেচনার বাইরে রেখে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর সন্ত্রাসবাদ এক প্রান্তিক বিষয় হয়েই বিরাজমান ছিল। বাস্তবে সন্ত্রাসবাদীরা যত না আমেরিকান অথবা ইউরোপীয় হত্যা করেছে, তার চেয়ে বেশি মেরেছে মুসলমান—বালি থেকে আম্মানে আর মরক্কো থেকে ইরাকে, ঘুরতি পথে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে।
পাশ্চাত্যে ওসামার হত্যাকাণ্ড ‘উদ্যাপন’ কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়—প্রশ্নগুলো একদমই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বাইরে। যেকোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি এসব প্রশ্ন তুলতে পারেন। মুসলমানদের আনন্দে উদ্বেলিত হওয়া তো দূরের কথা, সারা দুনিয়ায় তাদের বিপর্যস্ত করে চলেছে যে অনিশ্চয়তা, সেসবই ফুটে ওঠে এসব প্রশ্নে—ইসলামাবাদের এত কাছে বসবাস করেও ওসামা পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কীভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারলেন? সে ঘটনার ব্যাপারে পাকিস্তান ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিপরীতধর্মী বক্তব্যের আলোকে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্কটা আসলে ঠিক কী রকম? কেন ওসামাকে গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টা করা হলো না? আলোকচিত্রের অনুপস্থিতি, মৃতদেহ সাগরে সমাহিত করাকে (এটা ইসলামি রীতির প্রতি স্পষ্ট অশ্রদ্ধা প্রদর্শন, যদিও ওসামার হত্যাকারীরা দাবি করেছে, তারা মৃতদেহ সৎকারে ইসলামি রীতি অনুসরণ করেছে) কীভাবে ব্যাখ্যা করব আমরা?
এসব প্রশ্ন এবং তার ভেতর যে যুক্তিসংগত সংশয় ফুটে ওঠে, সেসব পাশ কাটিয়েও বলা যায়, সন্ত্রাসবাদের প্রতিভূ ও প্রতীক হিসেবে ওসামার মৃত্যু দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে নিতান্ত এক গুরুত্বহীন ঘটনা। ওসামার স্বপ্ন ও কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন বহুল বিস্তৃত ছিল না, অন্যদিকে তা মুসলমানদের শ্রদ্ধা অর্জনেও সক্ষম হয়নি। পাশ্চাত্যের সরকারচালিত নানা জরিপে এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যেও তার প্রমাণ মেলে। সর্বোপরি, ওসামার মৃত্যু মূলত আমেরিকান এবং আরও সাধারণভাবে বললে ইউরোপীয় ঘটনা। সরাসরি টেলিভিশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওসামার মৃত্যুর ঘোষণা এমন দৃঢ় ও সতর্ক ভাষায় পরিবেশন করলেন, যেন এই বার্তা যায় যে, আমেরিকার পয়লা নম্বর শত্রু ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের সময় বিরাজ করছে প্রশান্তি। ফাঁপা বড়াই করার ব্যাপার ছিল না।
জাতীয় নিরাপত্তা এবং ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের ব্যাপারে সামর্থ্য ও দৃঢ় সংকল্পের আপাতঘাটতির জন্য অতীতে বারাক ওবামাকে প্রচণ্ড তুলোধোনা করা হয়েছে। এবার তিনি বিরাট প্রতীকী সাফল্য অর্জন করলেন। জনমতের ওপর এর প্রচণ্ড প্রভাব পড়বে। তিনি যে ওসামার খোঁজ জারি রেখেছিলেন, শুধু তা-ই নয়, একদম গোপনীয়তা বজায় রেখে এবং সংবেদনশীল ও অবশেষে সফল অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা কিংবা আমেরিকান হিসেবে গর্বিত বোধ করার মতো গুরুতর সব ক্ষেত্রে অ্যাকশনে যেতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এ ঘটনায়—এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়।
তবে নিউইয়র্কের রাস্তায় ওসামার মৃত্যু উদ্যাপনে যেমন উচ্ছ্বাস দেখা গেছে, সেখান থেকে বহু দূরের পথ পাড়ি দিতেই হবে। আরব বিশ্বে একদিকে অত্যন্ত জনপ্রিয় শান্তিপূর্ণ বিপ্লব, অন্যদিকে সহিংস উগ্র পন্থার প্রতীক (এবং ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও প্রান্তিকীকৃত গোষ্ঠীগুলোর নেতা) নিহত হলেন। মধ্যপ্রাচ্যে এই বিপরীতধর্মী দুই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? সন্ত্রাসবাদীরা হয়তো পাল্টা জবাব দেবে; সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে তাদের প্রয়োজনীয় দৃঢ়তাসহকারে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু শক্ত কাজটি হবে, বিচ্ছিন্ন কিছু উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড মোকাবিলা ও পরাস্ত করা—কোনো পরিস্থিতিতেই এসব কর্মকাণ্ডকে ব্যবহার করা যাবে না রাজনৈতিক অ্যাকশনের দর্শনের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য। আগের আমেরিকান সরকার সেই পথটাতেই হেঁটেছিলেন। সহিংস উগ্র পন্থা আসলে যা, সে হিসেবেই তাকে বিবেচনা করতে হবে: ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং এগুলো অন্য ধরনের রাজনৈতিক ধারা, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজে কোনো গ্রহণযোগ্যতাই নেই।
ইসলাম এবং মুসলমানদের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সম্পর্কের নির্ধারক নতুন রাজনৈতিক দর্শনের উপাদানগুলো আবির্ভূত হওয়া সম্ভব হবে কেবল ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিস্তৃত আন্দোলনের আধার থেকেই। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে সেই জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচ্যে এসবের যে পুনর্জন্ম ঘটে চলেছে, তাকে আত্মজিজ্ঞাসার এক গুরুতর দাবি হিসেবে পাশ্চাত্যকে প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে। ‘সন্ত্রাসবাদের ক্যানসারের প্রতীক’ ওসামাকে বিনাশ করার আনন্দ উদ্যাপন শেষ হলে পাশ্চাত্যের উচিত দ্রুত তার আঞ্চলিক নীতি পর্যালোচনার দিকে ধাবিত হওয়া।
আফগানিস্তান ও ইরাকে অব্যাহত আমেরিকান ও ইউরোপীয় উপস্থিতি আর সেই সঙ্গে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধানে দৃঢ় সংকল্পের অভাব যেকোনো ইতিবাচক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক। এই তালিকায় আরও যোগ হবে কতগুলো অভ্যন্তরীণ বিষয়; যেমন—মানুষের মর্যাদা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আঘাত হানে—এমন বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন, গুয়ানতানামোর অস্তিত্ব এবং নির্যাতনের ব্যবহার। এগুলোর অনুশীলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্রদের প্রতি অবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে অথবা তেলসমৃদ্ধ শেখতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে বাছাই করা কয়েকজন স্বৈরশাসকের প্রতি সমর্থনদানের বিষয়ও শিগগিরই পুনর্বিবেচনা করা উচিত। নয়তো এসব নীতির ফলে যুক্তিসংগতভাবেই প্রশ্ন জাগবে, আরব বিশ্বের গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার প্রতি পাশ্চাত্যের প্রকৃত সমর্থন আছে কি না।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের ওপর নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যবস্থাপনার গুরুতর দায়িত্ব আছে। সহিংসতা ও উগ্রবাদের সাইরেন কখনো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি, এ কথা খুব জোর দিয়ে বলা যাবে না। জনগণ যেহেতু জেগেছে, তাই অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আরও বেশি দরকার সুশীল সমাজ (বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলসহ) একতাবদ্ধ ও সজাগ থাকা, দুর্নীতি এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ঘাটতি উন্মোচন; মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের অকৃত্রিম কৌশল উদ্ভাবন এবং অবশেষে পাশ্চাত্যের সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্মাণের শর্ত সৃষ্টি। কেননা ইসলাম ও পাশ্চাত্যের জুড়ি বহু পুরোনো; কেউ আর নবীন নেই। দূরপ্রাচ্য থেকে নতুন শক্তি (চীন দিয়ে যার সূচনা) এখনই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্যারামিটারগুলো পুনর্বিন্যস্ত করতে শুরু করেছে। দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো এবং চীন, ভারত ও তুরস্কের মতোই যুক্তরাষ্ট্র ঠিক জানে—আসলে কী ঘটে চলেছে।
এমনও হতে পারে, আরব ‘বসন্ত’ প্রকৃতপক্ষে আরব বিশ্বের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সম্পর্কের হেমন্ত এবং আরেক বৃহৎ বসন্তের নতুন পথ—এবার যে পথের দাগ টেনে দিচ্ছে প্রাচ্য ও এশিয়া। নতুন যে ভূ-অর্থনীতির জমিন আবির্ভূত হচ্ছে, তার পটভূমিতে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার ঘোষণার মধ্যে নিহিত শক্তি ততটাই, যতটা থাকে কোনো মলিন বায়ুপ্রবাহে অথবা যেমন-তেমন কোনো ঘটনায়।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
 তারিক রামাদান: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কনটেম্পরারি ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.