কালের আয়নায়-পশ্চিমা গণতন্ত্র এখন কত টাকায় বিক্রি হয়? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বিশ্বের সব দেশের মানুষই গণতন্ত্র চায়; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা মনে করে। কিন্তু গণতন্ত্রের অবস্থা এখন রূপকথার রাক্ষসপুরীতে বন্দিনী রাজকন্যার মতো। গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের রাক্ষসপুরী থেকে বন্দিনী গণতন্ত্রকে উদ্ধার করা না গেলে এ ব্যবস্থার পচন থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা যাবে না।


কিন্তু একে উদ্ধার করার পথটা কী? আর উদ্ধার করবেনই-বা কারা? গত রোববার (২৫ মার্চ) লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকা ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি ভয়াবহ বোমা ফাটিয়েছে। প্রথম পৃষ্ঠায় হাফপেজজুড়ে এবং ভেতরে পুরো দুই পাতাজুড়ে বিশাল খবর, প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সঙ্গে কেবল দেখা করার নজরানা (ডোনেশন) আড়াই লাখ (২,৫০,০০০) পাউন্ড। এই নজরানা দিতে পারলে যে কোনো ব্যবসায়ী ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যেতে পারবেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি রিস্ট্রিট চেকার্সের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে ডিনার খেতে পারবেন। সেই ডিনারে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী সামান্থা উপস্থিত থাকবেন। সেখানে নজরানাদাতা তার ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে যে কোনো গোপনীয় কথা বলতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী সরকারিভাবে কথাবার্তা না বললেও ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে গেলে টোরি পার্টির পলিসি মেকারের দল নজরানাদাতাদের দাবি-দাওয়া টুকে নেবেন। এমনকি সরকারের নানা গোপন তথ্যও তাদের জানার সুযোগ থাকবে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয়, অর্থমন্ত্রী অসবোর্ন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগসহ আরও দু'একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গেও তারা পরিচিত হতে পারবেন। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানের আইএসআই বিএনপিকে ১৯৯১ সালে ৫ কোটি টাকা দিয়েছে কি-না তা নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে, তখন ব্রিটেনে আড়াই লাখ পাউন্ডের নজরানায় গোটা ব্রিটিশ ক্যাবিনেট হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়_ সানডে টাইমসের মতো কাগজের এই খবরে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এই খবরের কাছে বাংলাদেশের খবর একেবারে নস্যি। সম্ভবত এই খবর বাংলাদেশে প্রচারিত হওয়ার পর মাত্র ৫ কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে তর্কাতর্কি এমনিতেই গুরুত্ব হারাবে।
সানডে টাইমসের এ খবর শুধু লন্ডনের অন্যান্য কাগজেই নয়, সারাবিশ্বের মিডিয়াতেই পল্লবিত হয়ে প্রচারিত হয়েছে। ব্রিটেনের ক্যামেরন সরকার এখন আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। মিডিয়ায়_ বিশেষ করে রুপার্ট মারডকের কাগজগুলোর তীব্র আক্রমণের মুখে প্রধানমন্ত্রীকে এ ধরনের নজরানা (ডোনেশন) গ্রহণের কথা স্বীকার করতে হয়েছে। যেসব বড় বড় ব্যাংকার, ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই নজরানা গ্রহণ করা হয়েছে, তাদের নাম প্রকাশ করতে হচ্ছে এবং টোরি পার্টির যে কো-ট্রেজারার (তিনি মিলিয়নিয়ার) এই ডোনেশন সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন, তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ব্যাপারটা শেষ মুহূর্তে কতদূর গড়াবে তা এখন বলা মুশকিল। এটাকে এখন পর্যন্ত স্ক্যান্ডাল বলা না হলেও এটা এক সময় আমেরিকার ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডালের মতো টোরিগেট স্ক্যান্ডাল হয়ে দাঁড়াবে কি-না তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে অনেকের ধারণা, এ খবর টোরি-লিব কোয়ালিশন সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দিতে পারে।
লন্ডনের এ খবর ওয়াশিংটনের ওবামা প্রশাসনেরও ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ওবামার প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পেইনের চাঁদা সংগ্রহের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো গোপন তথ্য নেই, এটা আগেভাগেই বলা শুরু হয়েছে এবং এ ধরনের কোনো গোপন তথ্য যদি থেকেও থাকে, তাহলে তা সতর্কতার সঙ্গে চাপা দেওয়া হবে বলে ওবামাবিরোধী শিবিরের কেউ কেউ মনে করেন। লন্ডনের এই নজরানা কেলেঙ্কারি নিয়ে লিখতে গিয়ে একটি পত্রিকায় একজন কলামিস্ট লিখেছেন, 'পশ্চিমা গণতন্ত্র সবসময়ই ক্যাপিটালিজমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। বর্তমানে তা গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের কাছে একেবারে বিক্রি হয়ে গেছে।' এই মন্তব্যটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, পশ্চিমা শিবির থেকে বলা হয়, সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। কিন্তু তারও আগে যে পশ্চিমা গণতন্ত্রে পচন ধরেছে এবং তার দুর্গন্ধ উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ভেতর দিয়ে চারদিকে ছড়াচ্ছে, তা তো চাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
বর্তমান ব্রিটিশ টোরি সরকারের নজরানা সংগ্রহে অবৈধ কিছু ছিল না বলে যদি প্রমাণ করাও যায়, তা সাধারণ মানুষের কাছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে অথবা ক্যামেরন সরকারের নৈতিক শক্তি কতটা অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে, তা সন্দেহের বিষয়। মার্কিন গণতন্ত্রে তো প্রকাশ্য পচন শুরু হয় নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির আমল থেকে। রিগ্যানের ইরানগেট কেলেঙ্কারি এবং বুশ জুনিয়রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সহায়তায় প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে বিতর্কমূলক জয় এবং সম্পূর্ণ মিথ্যাচারিতার ওপর ইরাক আক্রমণ এই পচনকে পূর্ণতা দেয়। এখন বহির্বিশ্বে মার্কিন গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল নয়। কালো ওবামাকে হোয়াইট হাউসে বসিয়েও তাকে সাদা করা যাচ্ছে না।
ব্রিটেনের বর্তমান ক্যামেরন সরকারের বিরুদ্ধে মারডকের সানডে টাইমস পত্রিকা যে ডোনেশন-কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলেছে, এ ধরনের অভিযোগ থেকে টনি ব্লেয়ারের নিউ লেবার মন্ত্রিসভাও মুক্ত ছিল না। টনি ব্লেয়ার লেবার পার্টিকে তার বাম সমাজতন্ত্রঘেঁষা চরিত্র থেকে সরিয়ে এনে প্রায় শ্যাডো টোরি পার্টিতে রূপান্তর করেছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের 'পুড্ল' হয়ে তিনি শুধু ইরাক যুদ্ধেই চরম মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নেননি, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, লর্ড সভায় সদস্য করার বিনিময়ে তিনি মোটা অঙ্কের নজরানা নেওয়া শুরু করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই তাকে গোয়েন্দা পুলিশের ইন্টারোগেশনের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এ ছাড়া নারী কেলেঙ্কারি তো আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন থেকে শুরু করে বর্তমান ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বব্যাংকের সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানের অঙ্গের ভূষণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের যে এত ব্যক্তিগত সুনাম, তার গণতান্ত্রিক সরকারও ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে জর্জরিত। আন্না হাজারে নামের মাত্র এক ব্যক্তির দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দিলি্লর এত বড় দরবারের ভিত্তি নড়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের কথা আর না তোলাই ভালো। এদেশে চোরের মায়ের বড় গলা। যে যত বড় চোর, তার মায়ের তত বড় গলা। শিক্ষা, বিচার বিভাগ, মিডিয়া ইত্যাদি যেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অসাধুতার প্রকোপ অনেক কম ছিল, তাও এখন কালো টাকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে অহরহ অভিযোগ উঠছে। মন্ত্রীরা আমলাদের কথায় ওঠেন-বসেন। আমলাদের বেশিরভাগ অসাধু ব্যবসায়ীদের কব্জায়। জাতির সার্বভৌমত্বের প্রতীক পার্লামেন্ট, তাতে এখন প্রকৃত রাজনীতিকদের উপস্থিতি নগণ্য। ব্যবসায়ীরাই সংসদ সদস্যদের চৌদ্দআনা। একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক তাই প্রশ্ন তুলেছেন, গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই কিনে ফেলতে ক্যাপিটালিস্টদের এখন কত টাকা লাগে?
আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লাগে। প্রার্থীরা তা কোথায় পান? তারা তখন চাঁদা ও নজরানার টাকায় নির্বাচন তহবিল গঠন করেন। বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বিরাট অঙ্কের টাকা দিয়ে আগেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের কিনে ফেলেন। ফলে যে দলের প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, তাকে মূলত এই ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও ডিরেক্টর বোর্ডের স্বার্থরক্ষা করে তাদের নির্দেশে চলতে হয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারা জনগণের স্বার্থে চালিত হওয়ার সুযোগ পান কম। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামার বেলাতেও এ কথা সত্য।
ব্রিটেনে টোরি প্রধানমন্ত্রীর নজরানা কেলেঙ্কারি যে ফাঁস হয়ে গেল, তার মূলেও রয়েছে গণতন্ত্রের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপনে ক্যাপিটালিস্টদের দুই শিবিরের পারস্পরিক বৈরিতা। এখানে এক পক্ষ রুপার্ট মারডকের মিডিয়া এবং অন্য পক্ষ ক্যামেরন সরকার। রুপার্ট মারডক সারাবিশ্বে অসীম ক্ষমতাশালী মিডিয়া সম্রাট নামে খ্যাত। মারডকের অঙ্গুলি হেলনে অনেক বড় বড় সরকারেরও পতন ঘটে। ফলে বিশ্বের উন্নত দেশের প্রভাবশালী সরকারও তাকে সমীহ করে চলে। সম্প্রতি ব্রিটেনের ক্যামেরন সরকার যে কোনো কারণেই হোক (সম্ভবত স্বার্থের সংঘাতে) মারডকের প্রতি এ সমীহা দেখাননি। টেলিফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারিতে তারা অভিযুক্ত মারডক মিডিয়ার বিরুদ্ধে তদন্ত চালায় এবং তার বহু বিশিষ্ট সাংবাদিক ও এক্সিকিউটিভকে গ্রেফতার করে। স্বয়ং মারডককে পুলিশি ইন্টারোগেশনের সম্মুখীন হতে হয়। তার মিডিয়াগুলোর মধ্যে সর্বাধিক প্রচারিত ও প্রভাবশালী সাপ্তাহিক 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডে'র প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়। মিডিয়া জগতে মারডকের আধিপত্য একটা বড় মার খায়।
মনে করা হয়েছিল, মারডক বুঝি মুখ বুজে এই মার সহ্য করবেন এবং তার কিছু আর করার নেই। কিন্তু মারডক যে মার খেয়ে মার হজম করেননি, ক্যামেরন সরকারের বিরুদ্ধে তার মারাত্মক পাল্টা হামলা সম্ভবত তার প্রমাণ। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই মারডকের মিডিয়া এম্পায়ারে সাম্প্রতিক ধস এবং ক্যামেরন সরকারের বিরুদ্ধে সেই মিডিয়ার পাল্টা আক্রমণের মধ্যে যোগাযোগ নেই_ এ কথা বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, ক্যামেরন সরকারের বিরুদ্ধে এটা মিডিয়া-মোগল মারডকের চরম প্রতিশোধ গ্রহণ।
এই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মারডক কয়েক মাস ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। তার কয়েকজন ঝানু রিপোর্টার মধ্যপ্রাচ্যের বিগ বিজনেসম্যানদের এজেন্ট সেজে টোরি প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং টোরি দলের এক কো-ট্রেজারারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং তাদের ফাঁদে ফেলেছেন। এই কো ট্রেজারারকে এখন পদত্যাগ করতে হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীকে ঘোষণা করতে হয়েছে, তিনি তার দলের অর্থ সংকট মোচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করবেন।
গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজম আজ নিজেই সংকটে জর্জরিত। টোটকা ওষুধে তার সংকট কাটবে, কেউ আশা করছে না। এই গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের ক্রোড়াশ্রিত গণতন্ত্রের শরীরে রীতিমতো পচন শুরু হয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেই তার সেই পচন-প্রক্রিয়া এখন প্রকট; আর এই গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোর গণতন্ত্রের অবস্থা কী, তা আজ আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার দরকার আছে কি?
বিশ্বের সব দেশের মানুষই গণতন্ত্র চায়; গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা মনে করে। কিন্তু গণতন্ত্রের অবস্থা এখন রূপকথার রাক্ষসপুরীতে বন্দিনী রাজকন্যার মতো। গ্গ্নোবাল ক্যাপিটালিজমের রাক্ষসপুরী থেকে বন্দিনী গণতন্ত্রকে উদ্ধার করা না গেলে এ ব্যবস্থার পচন থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা যাবে না। কিন্তু একে উদ্ধার করার পথটা কী? আর উদ্ধার করবেনই-বা কারা?
লন্ডন, ৩০ মার্চ ২০১২, শুক্রবার

No comments

Powered by Blogger.