বাবা, আজ জন্মদিন তোমার by দেওয়ান ফিদেল নাহিয়ান

বৃষ্টিভেজা সড়কপথ দেখলেই মন আনচান করে। আর যখন শুনি কোনো দুর্ঘটনা, তখন নিজেকে সামলাতে পারি না। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, দেশের সম্প্রচার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মিশুক মুনীরের অকালপ্রয়াণে আমার মধ্যে জেগে ওঠে বাঁচা-মরার অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যপট।
জন্ম-মৃত্যুর হিসাব মেলাতে ১৩ আগস্টের দুর্ঘটনা এবং এ মাসেরই ২৯ আগস্ট আমার বাবার জন্মবার্ষিকীতে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা আমি এই প্রথম কলম ধরলাম। স্মৃতি আমাকে প্রতিনিয়ত কাঁদায়। কেঁদে কেঁদে বলছি_ বাবা, আজ তোমার জন্মদিন। আমি লিখছি তোমাদের স্মরণ করে। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে জনপ্রতিবাদ জাগ্রত করতে।
আমার বাবা দেওয়ান মমিনুল মউজদীন। মরমি কবি হাছন রাজার প্রোপৌত্র। উত্তরাধিকারসূত্রে একজন কবি আর জনপ্রতিনিধি পরিচিতি ছিল দেশজোড়া। জনপ্রতিনিধিত্বের সুবাদে ভাবনায় ছিল শুধু মেঘালয়ের কোলঘেঁষা হাওরবেষ্টিত জনপদ সুরমাপাড়ের ছোট্ট শহর সুনামগঞ্জ। শান্ত-সুমন্ত শহরে একা একা ঘুরে তিনি উপভোগ করতেন জোছনামাখা শহরের অপার্থিব সৌন্দর্য। আবার কখনও অবহেলিত শহরটির নাগরিকদের দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে প্রতিবাদে দাপিয়ে বেড়াতেন হাওর-শহর। নিজেকে বোহেমিয়ান কবি ভাবতে ভালোবাসতেন বেশি।
বাবার কাছে শুনেছি, কৈশোরেই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। পশ্চিমবঙ্গে তখন নকশালবাড়ী আন্দোলন তুঙ্গে। সেই সময়ের অনেক তরুণের মতো বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন বাবা। আর কোমরে 'লাল বই' গুঁজে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। গ্রামের সাধারণ মানুষকে শোনাতেন সাম্যের গান। একটি সামন্ত পরিবারের সন্তান হয়েও বাবা মিশে গিয়েছিলেন নিপীড়িত মানুষের মাঝে। এক সময় তুমুল বাম আন্দোলন স্তিমিত হলো। নেতারা ফিরলেন ঘরে। স্বপ্ন ভেঙে গেল বাবার, কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। নিজের অবস্থান থেকে সারাজীবন কাজ করে গেছেন বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে।
সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। টানা তিনবার নির্বাচিত হয়ে সুনামগঞ্জ পৌরসভা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। দেশজুড়ে তার কবি-জনপ্রতিনিধি পরিচয়ের চেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন সাধারণের দাবিতে এককাট্টা হয়ে গণআন্দোলনে। দুর্নীতিবিরোধী, মাদকবিরোধী, বখাটেপনা-সন্ত্রাসবিরোধী আঞ্চলিক সফল আন্দোলনের পর তার ইচ্ছা ছিল সড়ক-আন্দোলনের ডাক দেওয়ার। যেদিন তিনি দুর্ঘটনায় মারা যান, সেদিনও জাতীয় একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তার কথা উদ্ধৃত ছিল।
বাবা তো ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের খুব বেশি সময় দিতে পারেননি। মাঝে মধ্যে ডেকে শোনাতেন চে, মাও সে তুং আর হুগো শাভেজের গল্প। কৈশোরের বিপ্লবী চেতনার প্রভাবে কিনা জানি না, ছোটবেলা থেকেই আমি বাবাকে দেখেছি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পক্ষে নানা লড়াইয়ে। পরিবর্তন চেয়েছিলেন আমার বাবা। স্বপ্ন দেখেছিলেন অন্য রকম একটি সমাজের। যার মূল্যও তাকে দিতে হয়েছে অনেক। জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন বহুবার। হারাতে হয়েছে বিপুল পারিবারিক সম্পদ। তবু পরোয়া করেননি। নিজে উজাড় করে দিয়ে গেছেন মানুষের জন্য।
বাবার বোহেমিয়ান চলাফেরা আর জনদাবির আন্দোলনে থাকা নিয়ে পারিবারিকভাবে হাজারও অভিযোগ থাকলেও আমার আম্মু সবসময় ছিলেন তার পাশে। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে জনসভা করতে বেরিয়েছেন বাবা। আর জায়নামাজে চরম উৎকণ্ঠিত আম্মু প্রার্থনা করেছেন বাবার ফিরে আসার। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে এমন কঠিন পরিস্থিতি আমিও নীরবে পার করেছি। সুনামগঞ্জের মানুষও বাবাকে দিয়েছেন অজস্র সম্মান। ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন বারবার। সব প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে বাবার ডাকে ছুটে আসতেন হাজার হাজার মানুষ।
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বাবা। ভোটার আইডি করতে সুনামগঞ্জ আসছিলাম আমরা। বাবাও তখন ঢাকায় ছিলেন। একটি কনফারেন্স শেষে ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট ফিরছিলেন আমাদের সঙ্গে। সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি ছিল। গাড়িচালকের পাশের সিটে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙল বাবার চিৎকারে। ঘাড় ফিরে তার দিকে তাকাতেই প্রচণ্ড শব্দ। আর কিছু মনে নেই।
সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে সেদিন আমি হারিয়েছি আমার বাবা, আম্মু আর একমাত্র ভাইটিকে। আর নিজে বেঁচে আছি মৃত্যু আর রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। এখনও শুধু মমিনুল মউজদীনের সন্তান বলে দূরদূরান্ত থেকে আমাকে দেখতে আসেন অজস্র মানুষ। অশ্রুসিক্ত চোখে ওই সব মানুষ যখন আমাকে আশীর্বাদ করে বলেন, 'বেঁচে থাকো, বাবার মতো হও... তোমার বাবা অনেক করেছেন আমাদের জন্য...তার মৃত্যুতে পেয়েছি স্বজন হারানোর ব্যথা...।' আমি তখন অনুভব করি, আমাদের সময় দেওয়ার চেয়ে সেসব সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন আমার বাবা।
কীভাবে ফিরে এলাম আমি মৃত্যুর মুখ থেকে! আমার সহযাত্রী বাবা, মা, আদরের ছোট ভাই কাহলিল জিবরান আর গাড়িচালক_ তারা সবাই তো মৃত্যুর কাছে পরাজিত। বেঁচে আছি আমি অপার এক শূন্যতায়। ইচ্ছা আছে, বাবার ভক্ত সাধারণ মানুষজনকে নিয়ে একদিন বাবার মতো রুখে দাঁড়াব সড়কপথে প্রাণ সংহার নামে অরাজকতার বিরুদ্ধে। আজ ২৯ আগস্ট। আমার বাবার ছাপ্পান্নতম জন্মদিন। এদিনে মনের ইচ্ছাটা জানিয়ে বলছি_ সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে একদিন জাগ্রত হবে জনপ্রতিবাদ। স্বজন হারানোর অতল শূন্যতার মাঝ থেকে স্মরণ করছি আমার বোহেমিয়ান বাবাকে। স্মরণ করি সড়ক দুর্ঘটনায় সব হতাহতকে।
দেওয়ান ফিদেল নাহিয়ান :মমিনুল মউজদীনের সন্তান

No comments

Powered by Blogger.