চারদিক-হালুয়াঘাটের ফুল মিয়া by ইয়াসমীন রীমা

নদীভাঙা মানুষ ফুল মিয়া। পৈতৃক ভিটেবাড়িটা গত তিন বছরে রাক্ষুসী নদী ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে। আশ্রয়হীন হয়ে বেশ কিছুদিন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি থেকেছেন। কিন্তু এত বড় পরিবার কে কয় দিন আশ্রয় দিয়ে রাখতে পারে। খেটেখাওয়া মানুষ ফুল মিয়া নতুন করে বসতবাড়ি কিনবেন, এমন অবস্থাও নেই।


তা ছাড়া পৈতৃক ভিটেটা উদ্ধারের উপায় না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি।
ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটের অধিবাসী ফুল মিয়ার আশ্রয় বলতে যখন আর কিছুই থাকল না, তখন স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে একদিন রাতে অজানার উদ্দেশে লোকাল ট্রেনে চড়ে বসেন। সারা রাত নিজস্ব গতিতে চলে কুমিল্লা স্টেশনে এসে ট্রেনের গতি থেমে যায়। নেমে পড়েন পঞ্চাশোর্ধ্ব ফুল মিয়া পরিবার-পরিজন নিয়ে। অচেনা-অজানা শহরে কী করবেন তিনি? অনেক ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় পান শাসনগাছা মির্জারপাড় বস্তিতে। গৃহপালিত গরু বেচার শেষ কিস্তির টাকাটা দিয়ে একটা খুপরি ঘর ভাড়া নেন। কিন্তু কাজ ছাড়া কী করে খাবেন? কাজের সন্ধান করতে থাকেন। এরই মধ্যে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আক্কাস আলীর। আক্কাস আলীর পরামর্শে মাত্র ৯০ টাকা পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েন তিনি বেশি মুনাফা ও প্রতিযোগিতাহীন এই ব্যবসায়। ফুল মিয়ার সঙ্গে আক্কাস আলীও এ ব্যবসা করেন। তবে তিনি সারা বছর এ কাজ করেন না। শুধু গ্রীষ্মকালে। এতে ফুল মিয়ার সুবিধা বেশি। বলতে গেলে তখন একেবারে প্রতিযোগিতাহীন।
ব্যবসাটা একটু ভিন্ন হলেও ফুল মিয়া এ কাজে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সারা দিন তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে চুল সংগ্রহ করেন বেলুন, ফিতা, কম দামের দুল, চিরুনি ইত্যাদির বিনিময়ে। কোনো কোনো দিন অন্য উপজেলাগুলোয় চলে যান। বিশেষ করে, মেয়েদের উঠে যাওয়া চুলের গোছা, যেগুলো সাধারণত আঁচড়াতে গিয়ে, হাত বোলাতে গিয়ে, নয়তো খামোখা উঠে যাওয়া চুল তিনি সংগ্রহ করেন। কখনো কখনো বিভিন্ন বাড়িতে আগে থেকে বলা থাকে, উঠে যাওয়া চুলগুলো যাতে না ফেলে দেয়। তাই উপজেলার গ্রামগুলোর মা-বোন, বউ-ঝিরা ফুল মিয়ার জন্য চুল জমিয়ে রাখেন। বিনিময়ে তাঁরা পেয়ে যান তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সাজগোজের সামগ্রী কিংবা ছেলেভোলানো খেলনাপাতি। তাই ফুল মিয়া কোনো গ্রামে ঢুকলে ছেলে-বুড়ো সবারই মধ্যে একটা হল্লা পড়ে যায়। গ্রামে গ্রামে গত দেড় বছরে এত পরিচিত হয়ে গেছেন যে সবাই তাঁর নাম দিয়েছে ‘চুল মিয়া’। কোনো কোনো দিন বেশি পরিচিতজনদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থাটাও হয়ে যায়।
যে খেলনাপাতি কিংবা সাজের সরঞ্জামগুলো ফুল মিয়া চুলের সঙ্গে বিনিময় করেন, সেগুলো কুমিল্লার পাইকারি দোকান থেকে সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০-২০০ টাকা পুঁজির দরকার হয়। ঘোরাঘুরি করে বেশি পরিমাণ চুল সংগ্রহ হলে সেগুলো নিয়ে তিনি চলে যান ময়মনসিংহ কিংবা নোয়াখালীতে। সেখানে আছে চুলের খোঁপা তৈরির ছোট কারখানা। আর এই কারখানার মালিকদের কাছে চুলের চাহিদা অনেক। প্রতি কেজি চুল তাঁরা কেনেন ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। এক কেজি চুল দিয়ে কারখানার মালিকেরা খোঁপা তৈরি করেন চার থেকে পাঁচটি, যার প্রতিটির মূল্য ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। সেলুনের কাটা চুল কিংবা পুরুষদের চুল কারখানার মালিকেরা নিতে চান না। এ চুল কোনো কাজে লাগে না। তবে ফুল মিয়া শুনেছেন, এখন নাকি সেলুনের চুলও বিক্রি করা যায়, রং কোম্পানিওয়ালারা এই চুল কেনে। তবে কোথায় এর ঠিকানা, এখনো তা জানতে পারেননি, খোঁজ লাগিয়েছেন।
ফুল মিয়া কুমিল্লা বিসিক শিল্প এলাকার কর্মকর্তার কাছে আরও জেনেছেন, কুমিল্লা, বরগুনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে কেনা চুল কুষ্টিয়ায় জড়ো করা হয়। তারপর ওখান থেকে বোধ হয় সীমান্ত পেরিয়ে চলে যায় ভারতে। তাঁর মতে, ভারত থেকেই এসব চুল বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ফুল মিয়া মাসে দু-তিনবার চুল বিক্রি করতে যান; প্রতিবার গড়ে তিন-চার কেজি চুল বিক্রি করেন। কিন্তু এর জন্য তাঁকে মাসের ৩০ দিনই চুল সংগ্রহের জন্য অনেক খাটতে হয়। দিনপ্রতি হিসাব করলে তাঁর আয় হয় ১৫০-১৭০ টাকার মতো। এতে তাঁর সংসার দিব্যি চলে যায়। কষ্টের দিনগুলো তাঁর কিছুটা ঘুচে গেছে। ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো দুবেলা খেতে পারছে। বস্তিঘর ছেড়ে তিনি এখন দুই কক্ষের ঘর ভাড়া নিয়েছেন।
সারা বছর এ কাজটি করবেন কি না, জানতে চাইলে শ্বাসকষ্টের রোগে আক্রান্ত ফুল মিয়া জানান, আরও কিছু টাকা জমাতে পারলে একটা সাইকেল কিনবেন এবং আরও ভালোভাবে ব্যবসাটা করবেন।
ইয়াসমীন রীমা

No comments

Powered by Blogger.