শত্রুমিত্রের পার্থক্যবিচার by রণজিৎ বিশ্বাস

শত্রু ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে কখনও ভেবেছেন? : ভেবেছেন মানে! ভেবেভেবেই তো চুল পাকাচ্ছি! অন্যের তুলনায় আমাকে একটু বেশিই ভাবতে হয়, কারণ দু'তরফেই আমার ভাগ্য খুব ভালো : আমরাও যাতে ব্যাপারটা বুঝতে পারি, বিষয়টার ওপর কয়েক মিনিট বলুন না।


: প্রথম কথা হচ্ছে_ একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে_ শত্রু শত্রুর মতো, মিত্র মিত্রের মতো। তৃতীয় কথা হচ্ছে_ মানুষ বিপদে পড়লে শত্রু হাসে মিত্র কাঁদে। চতুর্থ হচ্ছে_ মানুষ শত্রুর শত্রুকে কখনও কখনও ভুলক্রমে মিত্রজ্ঞান করে কিন্তু মিত্রের মিত্রকে কখনও শত্রুজ্ঞান করে না। পঞ্চম হচ্ছে_ শত্রুরও মিত্র থাকে, থাকে মিত্রেরও শত্রু। ষষ্ঠ হচ্ছে_ অজাতশত্রু মানুষের কথা কখনও কখনও শোনা যায়, কিন্তু অজাতমিত্রের কথা কখনও শোনা যায় না। সপ্তম হচ্ছে_ শত্রুর নামে মানুষ এক গ্রাস ভাত বেশি খায়, মিত্রর নামে খায় না। অষ্টম, শত্রু কখনও মিত্র হয় না, কখনও কখনও তারা মিত্রের ভান করে; কিন্তু মিত্রদের শত্রু হয়ে যাওয়ার শঙ্কা সবসময় থাকে। মিত্ররা যখন শত্রু হয়, আসল শত্রু তখন লজ্জা পায়। কারণ তাদের শত্রুতা আসল শত্রুর দুশমনির চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। তারা মুখখোলা গ্রেনেডে পরিণত হয়। জীবনে তাদের আর মিত্রের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা যায় না।
নবম, শত্রুর মধ্যে আসল-নকল নেই, শত্রু শত্রুই; তাদের মধ্যে ছোট-বড় কিংবা লঘু-গুরু থাকলে থাকতে পারে; কিন্তু মিত্রের মধ্যে আসল-নকল আছে। দশম, শত্রুকে চেনা যায়, তাদের বিরুদ্ধে রণকৌশল সাজানো যায়; কিন্তু নকল মিত্রদের অন্তর্ঘাত বোঝা যায় না। একাদশ, মিত্রের মিত্র হয়, শত্রুর হয় না। দ্বাদশ, শত্রু শত্রুকে চিনতে কখনও ভুল করে না; কিন্তু মিত্র মিত্রকে চিনতে কখনও কখনও গলতির শিকার হয়। এয়োদশ, শত্রুর সঙ্গে শত্রুর শুধু শত্রুতার সম্পর্ক, মিত্রের সঙ্গে আপাত মিত্রের অথবা মিত্রের সঙ্গে ছদ্মমিত্রের অকৃতজ্ঞতা ও কৃতঘ্নতার সম্পর্ক। চতুর্দশ, মানুষ জ্ঞানত কিংবা অজ্ঞানত শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয় এবং মিত্রের হাতকে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করে। পঞ্চদশ, মিত্ররা কখনও কখনও মিত্রকে চেনে না, কিন্তু শত্রুরা শত্রু চিনতে কস্মিনকালেও ভুল করে না। ষোড়শ, শত্রুরা শত্রুতার জন্য একাট্টা থাকে, মিত্ররা কল্যাণ ও মিত্রতার প্রশ্নেও থাকে ছাড়াছাড়া, কাটাকাটা। সপ্তদশ, শত্রুরা কখনও কখনও বর্ণচোরা গিরগিটি কিংবা স্করপিঁয়র মতো ক্যামোফ্লেজ করে, সত্যিকার মিত্ররা এই কাজটি জানে না। অষ্টদশ, শত্রুরা কখনও কখনও পিঠে আঘাত করে এবং পরাজিত হলে পিঠ দেখায়, মিত্ররা বুক পেতে দেয়, কাঁধ বাড়িয়ে দেয়, কখনও কখনও মাথা দিয়েও ঠেকায়। ঊনবিংশ, যুদ্ধাপরাধী, ওয়ার ক্রিমিনাল, অপচিত মুক্তিযোদ্ধা, বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা এবং সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িকজনেরা কখনও মিত্র হতে পারে না, কিন্তু চিরদিন তারা মানবতাপ্রিয়, স্বাধীনতাপ্রিয়, আধুনিক, শিক্ষিত, রুচিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও সৎ মানুষের দুশমন হয়েই থাকে। বিংশ, শত্রুরা প্রতিহিংসাপরায়ণ ও প্রতিশোধপ্রবণ হয়, মিত্ররা কখনও কখনও মিত্রের ব্যাপারেও কল্যাণমুখী কিংবা উপকারপ্রবণ হয় না। একবিংশ, প্রকৃত বল্পুব্দ উৎসবে থাকে, সুদিনে থাকে, দুর্দিনে থাকে, রাজদ্বারে থাকে ও শবযাত্রায় থাকে। শত্রু এর কোনোটিতেই থাকে না। দ্বাবিংশ ও আপাতত সর্বশেষ_ মানুষ শত্রুর ছেলেকে বাঘ মারতে পাঠায়, মিত্রের ছেলেকে নয়।
: দ্বাবিংশ নম্বর কারণটি একটু বুঝিয়ে বলতে হবে।
: সিম্পল। এ ক্ষেত্রে দুটি লাভ পরিষ্কার। শত্রুর ছেলে মারা গেলেও লাভ, বাঘ মারা গেলেও লাভ। তৃতীয় একটি লাভও আমি খুঁজে পেয়েছি। নিজের ঔদার্য ও নিরপেক্ষতার প্রচার করা যায়। বুক ফুলিয়ে কিংবা শার্টের কলার নেড়ে বলা যায়, দেখ সমালোচকরা, আমার বিচার প্রশ্নাতীত। বাঘ মারার মতো বীরত্বপূর্ণ কাজে পাঠাবার সময়ও আমি শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ করি না।
: কোন অরিবৈরী বা ছদ্মসুহৃদ আপ কখনও বাঘ মারতে পাঠিয়েছে?
: একাধিকবার!
: তার রেজাল্ট কী?
: প্রতিবারই আমি শত্রুর উপকার করেছি।
: কীভাবে?
: মারা গিয়ে নয়, বাঘ মেরে।
: স্বীকৃতি পেয়েছেন?
: প্রতিবারই। বড় উদারভাবে।
: কীভাবে?!
: একটিমাত্র ছোট, সুন্দর, স্পষ্ট ও শব্দহীন বাক্যে।
: বাক্যটি কী?
: 'ও একটি গর্দভ'।
 

No comments

Powered by Blogger.