কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে by রণজিৎ বিশ্বাস

ওপরের দিকে তাকানো ও নিচের দিকে তাকানোর মধ্যে আপনি কি তফাত খুঁজে পান? : পাব না কেন?! এ নিয়েই আমার জীবন চলে। কখনো কখনো পিছলে পড়ি, নিদেন আমি চালাতে চাই। আগে আমি ওপরে-নিচে তাকানোর কাজগুলো যতটা করতাম, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি করি।


: বেশি করার কারণ?
: কারণ যিনি আমাকে কাজটা শিখিয়েছেন, তিনি এখন কাজটা করেন না। যে শিক্ষা তিনি অন্যকে দিয়েছেন আনন্দের সঙ্গে, অন্যকে বিস্ময়ের ঘোরে গলা টিপে মেরে তা থেকে তিনি এখন বিচ্যুত। কী কারণে তিনিই জানেন এবং তাঁর চেয়ে ভালো দ্বিতীয় কেউ জানেন না, তিনি এখন সেই শিক্ষা থেকে যোজন যোজন দূরে। তাঁর জন্য আমার কষ্ট হয়। যত কষ্ট হয়, তাঁর শেখানো কথাটাকে আমি বেশি বেশি স্মরণ করি। কখনো কখনো করুণারস তাঁর মস্তকপরে আমি বর্ষণও করি।
: পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করুন।
: বয়সের মাপে তিনি আমার শিক্ষক হতে পারতেন। কিন্তু প্রথাগত অর্থে আমার শিক্ষক তিনি নন। শ্রমজীবনে তিনি আমার অগ্রবর্তী শ্রমিক। অনেক সফল শ্রমিক ও কৃতী শ্রমিক। অবশ্য আমি জানি না, নিজের শ্রমিক পরিচয়ে তিনি গর্ব বোধ না করুন, স্বস্তি অন্তত বোধ করেন কি না। আমি অগ্রজপ্রতিম এই শিক্ষকসন্তানের কাছে ইটাইমোলজি (etymology : শব্দের নিদানতত্ত্ব ও উৎপত্তি বিজ্ঞান) শিখেছি, অনুপ্রাসের সূক্ষ্ম বিভাজন অ্যালিটারেশন (Alliteration) ও অ্যাসোন্যান্স (Assonance) শিখেছি। এই শিক্ষা আমি বিভিন্ন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভোকাবুলারি (Vocabulary : শব্দসম্ভার) ও বিভিন্ন রেটোরিকাল টার্মস বা টার্মিনোলজি (Rhetorical terms) আলোচনার সময় প্রয়োগ করি। আমার শ্রোতাদের চেহারা বলে দেয়, তারা তা গ্রহণ করছে। উদাহরণসহ তা শুনতে তাদের ভালো লাগছে। যতবার এই আনন্দময় উপলব্ধি ও সন্তোষের বোধ জাগে, ততবার আমি তাঁকে স্মরণ করি। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। নইলে আমি কোন অজাতীয় প্রাণী যে সাহিত্যের ডিগ্রি না থাকার পরও সাহিত্যের এসব বিষয় নিয়ে ক্লাসরুমে ভ্যাজরভ্যাজর করব! আর সাহিত্যের ছাত্ররাও তা মেনে নেবে!
তিনি আমাকে বলতেন, আমার বাবা বলতেন- সব সময় নিচের দিকে তাকাবি, দুই ক্ষেত্রে ওপরের দিকে। আমি বলতাম, বুঝলাম না! তিনি বলতেন, সব ক্ষেত্রে মানে, জাগতিক, বৈষয়িক ও ধনসম্পদভিত্তিক সব ক্ষেত্রে। অমুকের সাতটি শার্ট আছে, আমার তিনটির বেশি নেই কেন! অমুকের তিনটি বাড়ি আছে, তেত্রিশ বছর চাকরি করার পর একটিও আমার নেই কেন! সমুকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা-পয়সা ঠেললে ঠেলা যাচ্ছে না, আমার অ্যাকাউন্টে কেন ধূ ধূ মরুভূমি!
এ রকম ভাবনা মানে ওপরের দিকে তাকানো। এমন না ভেবে তুমি যদি এমন ভাব- অমুকের তো একটি শার্টও নেই! তমুক তো ভাড়াবাড়িতেও থাকতে পারে না! তাহলে দেখবে তুমি শুধু সান্ত্বনাই পাবে না, বিশাল একটা স্বস্তিও পাবে। নিজেকে তোমার অনেকের চেয়ে ভাগ্যবান মনে হবে। নইলে হতাশা এসে তোমাকে ঘিরে ধরবে। নিজেকে তোমার ক্ষুদ্র, খর্ব ও ব্যর্থ মনে হবে। কাজে তোমার মন বসবে না। ঊর্ধ্বপানে তুমি ছুটতে থাকবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই তোমার ছোঁয়া হবে না। এভাবে করতে করতে একদিন তুমি বসে যেতে পারো, একদিন তুমি ধসে যেতে পারো, মাটিতে মৃত্তিকায় আর কাদায় তুমি মিশে যেতে পারো। আমি এসব খুব প্রচার করতাম। এখনো করি। আমার ছাত্ররা-পুত্ররা-কন্যারা-ভগিনীরা ও তরুণ সহকর্মীরা কেউ কেউ গ্রহণও করে। তাঁর মুখে কথাগুলো আমার ভালো লাগত। আমার মনে ধরত। ভালো লাগত, যখন তিনি বলতেন, দুই ক্ষেত্রে ওপরের দিকে তাকানোর বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। জ্ঞান ও সততা। বলতে পারো, যাবতীয় গুণ এবং শিক্ষা বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ।
এ দুই ক্ষেত্রে তোমাকে রীতিমতো লুব্ধ হতে হবে। অমুক অতটা জেনেছে, ততটা শিখেছে, আমি কেন পারিনি! আমি কেন পারি না! সমুক অতটা নির্লোভ, তমুকের মানবিক উৎকর্ষ ও সততা অমন ঈর্ষণীয় রকম শংসনীয়, আমি, এই অপদার্থ কেন তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারি না! এই রকম ভাবনার নাম হচ্ছে ওপরের দিকে তাকানো। এভাবে যদি তুমি যথাপ্রয়োজন ওপরের দিকে ও নিচের দিকে তাকাতে পারো, ধরে নিতে পারো, একটা অর্জন তোমার হয়েছে।
সে অর্জন আমার হয়নি। এ জন্য দুঃখ আছে। তাঁর চেয়েও বেশি দুঃখ, এসব যিনি আমাকে অর্জেয় ভাবিয়েছেন, তিনি তাঁর জায়গায় থাকতে পারেননি।
: আপনার এই বোধের নাম কী দেবেন?
: হতাশা বললে বলতে পারেন, তবে শব্দটা বোধ হয় খুব জোলো হবে।
'হৃদিভঙ্গ' বললে ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। অন্য কথা পাড়ুন।
: এমন হৃদিভঙ্গের আর কোনো অভিজ্ঞতা আছে?
: আছে। এমন আরো অনেক ঘটনা আমার 'মজবুতি' বাড়িয়েছে।
: যেমন?
: আমার অগ্রবর্তী এক সহকর্মী তাঁর রুমের দেয়ালে একটা মটো (motto) বাঁধাই করে লাগিয়ে রেখেছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পুরস্কার (শান্তি) পাওয়া মার্টিন লুথার কিংয়ের (জুনিয়র) অবিস্মরণীয় একটি উক্তি। 'Injustice anywhere is a threat to justice everywhere' (অন্যায় যেখানেই হোক, তা সর্বত্রই ন্যায়ের প্রতি হুমকি)।
এই 'শ্রমিক' তাঁর কাছে কেউ কোনো তদবির কিংবা অন্যায় আবদার নিয়ে এলে মুখে কিছু বলতেন না। শাসনাঙ্গুলি তুলে দেয়ালের ওই ফ্রেম নির্দেশ করতেন। বড় নাটকীয় ভঙ্গিতে। তিনি সেদিকে তাকাতেনও না। স্টাইলটা আমার খুব স্মার্ট মনে হতো। আমি বেশ উপভোগ করতাম।
: তারপর?
: তারপর সেই আনন্দস্মৃতি আমাকে বেশ চুপসে দিত। আপন প্রয়োজনে তিনি ১৮০ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্বে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁর সোৎসাহ পদক্ষেপে আমাকেও জীবনের এক কঠিন জংশনে এসে ভুগতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোনো অসুবিধা আমার হয়নি।
হতাশায় ডুবতে ডুবতে আমি তখন রবীন্দ্রনাথের 'প্রশ্ন' আমার কণ্ঠে তুলে নিতাম। শব্দহীনতায়। "ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে-
তারা বলে গেল 'ক্ষমা করো সবে', বলে গেল 'ভালোবাসো-
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো'।
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে"
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.