গণপরিবহন-উড়ালসড়কে কি সবাই ‘উড়তে’ পারবেন? by এ কে এম জাকারিয়া

এখন উড়ালসেতু ও উড়ালসড়কের সময়। রাজধানী ঢাকায় এখন অন্তত তিনটি উড়ালসেতু (ফ্লাইওভার) নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী, কুড়িল, ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে মিরপুর-বনানী ফ্লাইওভার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩০ এপ্রিল উদ্বোধন করেছেন দেশের প্রথম উড়ালসড়কের (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণকাজ।


এই উড়ালসড়ক শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, গোলাপবাগ হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে যুক্ত হবে। পরে তা উত্তরে জয়দেবপুর চৌরাস্তা ও দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। সামনে আরও আসছে, গুলিস্তান-বউবাজার ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। ঢাকার রাস্তায় আমরা যারা চলাচল করতে গিয়ে পথেই অনেক সময় খুইয়ে ফেলি, তাদের কাছে এসব খবর অবশ্য আশা জাগায়, এগুলো তৈরি হলে পরিস্থিতিটা হয়তো সহনীয় হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই উড়ালসড়কে কি সবাই ‘উড়তে’ পারবে? এই সড়কে ‘উড়াল’ দিয়ে যেতে পয়সা গুনতে হবে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) এই উড়ালসড়ক তৈরি করতে খরচ পড়বে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ফেরতও আনতে হবে। যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে ২১ কিলোমিটারের এই পথ পাড়ি দিতে একটি প্রাইভেট কারকে দিতে হবে ১২৫ টাকা, বাসকে ২৫০ টাকা, ট্রাককে ৫০০ টাকা। এর চেয়ে বড় গাড়িকে দিতে হবে ৭৫০ টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, কোন ধরনের যানবাহন ব্যবহার করবে এই উড়ালসড়ক। প্রথমত, প্রাইভেট কার, যাদের সামর্থ্য আছে যানজট এড়িয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল আসতে বা যেতে তেল বা গ্যাসের খরচের বাইরে এই টাকা খরচ করার। দ্বিতীয়ত, যেসব যানবাহন ঢাকার যানজট এড়িয়ে রাজধানীর উত্তর প্রান্ত থেকে চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কের দিকে যেতে চায় বা আসতে চায়, তারাই ব্যবহার করবে এই উড়ালসড়ক। টোলের কারণে এই উড়ালসড়কে সবাই ‘উড়তে’ পারবেন না। কিছু প্রাইভেট কার, আন্তজেলা বাস বা পণ্যবাহী ট্রাকই হবে এর প্রধান ব্যবহারকারী। এই উড়ালসড়ক ও ফ্লাইওভারগুলো তৈরি হলে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির চাপ যে কমবে, পরিস্থিতি যে অনেকট সহনীয় হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে একটি নগরের গণপরিবহন বলতে আমরা যা বুঝি তাতে কোনো কাজে আসবে না এই উড়ালসড়ক।
উড়ালসেতু ও উড়ালসড়কের সবগুলোই বর্তমান মেয়াদের মধ্যে শেষ করতে চায় সরকার। যদিও উড়ালসড়ক নির্মাণের সম্ভাব্য সময়সীমা হচ্ছে সাড়ে তিন বছর। সে হিসাবে এটির নির্মাণকাজ হয়তো শেষ না-ও হতে পারে। টাকা-পয়সার হিসাবে দেখলে এই চারটি প্রকল্পই অনেক বড়। উড়ালসড়কের নির্মাণব্যয় আট হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতুর নির্মাণব্যয় এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা, কুড়িল উড়ালসেতুর ১৫৩ কোটি টাকা ও মিরপুর-বনানী উড়ালসেতুর ১৯৩ কোটি টাকা। সরকারের পরিকল্পনায় আরও নতুন উড়ালসেতুর কথা শোনা যাচ্ছে, যানজট কমাতে সেগুলোও ভূমিকা রাখবে, কিন্তু গণপরিবহন বলে যে একটি বিষয় আছে, সে ব্যাপারে সরকারের অনাগ্রহ সত্যিই প্রশ্ন জাগায়।
পুরো ঢাকায় (প্রায় ৪০০ কিলোমিটার) গণপরিবহনের আধুনিক ব্যবস্থা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) গড়ে তোলার যে পরিকল্পনার কথা শোনা গিয়েছিল, তার কোনো অগ্রগতি নেই কেন? এ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট লেন দিয়ে বাস চলবে, চাইলেও ডানে-বাঁয়ে যেতে পারবে না, যেখানে-সেখানে থামতেও পারবে না। প্রাইভেট কারের চাপে অচল হয়ে যাওয়া এই শহরের জন্য বড় স্বস্তি হতে পারে এ ব্যবস্থা। এ ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের যে খরচের কথা শোনা গেছে, তা মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা। উড়ালসড়ক ও ফ্লাইওভারের তুলনায় এই খরচকে ‘মাত্র’ বলেই উল্লেখ করতে হয়। সরকার বা নীতিনির্ধারকদের অনাগ্রহের কারণ কী? কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি, একজন জানালেন, এ ধরনের প্রকল্পে ভাগ-বাটোয়ারার সুযোগ নাকি কম, তাই এসব পরিকল্পনা আরও যাচাই-বাছাই বা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে পেছনে ফেলে রাখা হচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে একটি লেখায় পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. রহমত উল্লাহকে উদ্ধৃত করেছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু উড়ালসড়কে কাজ হবে না, একই সঙ্গে মেট্রো রেল ও বিআরটির সমন্বয়ে একটি গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’ আমরা দেখতে পাচ্ছি ঢাকা শহরের পরিবহন নিয়ে সরকারের সব ভাবনায় ফ্লাইওভার বা উড়ালসড়কেই স্থান পাচ্ছে। গণপরিবহনব্যবস্থা বিবেচনার বাইরেই রয়ে যাচ্ছে। ভাগ-বাটোয়ারার তত্ত্বই কি তবে সত্যি?
দুনিয়ায় সব বড় বড় শহরেই লোকজন বাড়ছে, গাড়ি-ঘোড়ার সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে যাত্রীর সংখ্যা। এই পরিস্থিতি সামালও দেওয়া হচ্ছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন ও কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা—এই হচ্ছে পথ। গণপরিবহনব্যবস্থা নিয়ে কিছু না হলেও এই যে আমাদের ঢাকায় এখন তিন-তিনটি ফ্লাইওভার ও একটি উড়ালসড়ক তৈরির কাজ চলছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু কাজ হচ্ছে। সামনে এর ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু ট্রাফিক-ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে তো কোনো বড় চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। রাস্তায় গাড়ি কীভাবে চলবে, এই সাধারণ নিয়মকানুন এখনো ঠিক করা যায়নি। আধুনিক ট্রাফিক-ব্যবস্থার স্বীকৃত কিছু নিয়মকানুন আছে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। আমাদের এখানে এসবই অচল। দুনিয়ার সব বড় বড় শহরে গাড়ি চলে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল মেনে। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা কাজে দেয় না। এখানে লাল-সবুজ যে বাতিই জ্বলে থাক আপনাকে চলতে হবে ট্রাফিক পুলিশের হাত কখন উঠছে আর কখন নামছে, সেদিকে তাকিয়ে।
ঢাকা শহরের ট্রাফিক-ব্যবস্থা কীভাবে চলবে, কী কী নিয়ম মেনে চলা হবে, ঢাকা শহরের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বা সরেজমিনে দেখেশুনে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। গত ১৯ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত আড়াই বছরে ঢাকা শহরের ট্রাফিক পরিস্থিতি ও সড়ক নিরাপত্তার উন্নয়নে সরকার অন্তত ১০টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার একটিও কার্যকর করা যায়নি। এই সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিটি কার্যকর করার দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল, আগাম ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছিল ওমুক দিন থেকে এটা কার্যকর হবে। আজ থেকে লেইন মেনে গাড়ি চলবে, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের পদ্ধতি মেনে গাড়ি চলবে ওমুক দিন থেকে বা ১৫ বছরের পুরোনো গাড়ি কাল থেকে আর ঢাকায় চলবে না—এমন নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ঘোষণা দিয়ে শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই তা মিইয়ে গেছে। তার মানে ভেবেচিন্তে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অনেক স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা এখন অচল বা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কাজ করছে না, ঢাকার অনেক রাস্তায় দাগ দিয়ে লেন ঠিক করা নেই। ১৫ বছরের পুরোনো গাড়ি সরিয়ে ফেলা আমাদের বাস্তবতায় সম্ভব কি না, এ ধরনের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া বা তা কার্যকরের চেষ্টায় নামার আগে।
সিট বেল্ট পরে গাড়ি ও হেলমেট পরে মোটরসাইকেল চালাতে হবে, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা যাবে না, পথচারীদের ফুটপাত ব্যবহার করতে হবে, রাস্তা পার হতে হবে ফুটওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস দিয়ে—এগুলো সাধারণ নিয়ম। এসবও দিনক্ষণ দিয়ে কার্যকরের ঘোষণা এসেছিল। এখন রাস্তায় দেখতে পাবেন অসংখ্য লোক মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন হেলমেট ছাড়া, চালকের সিট বেল্ট বাঁধা নেই। অনেক গাড়িতে সিট বেল্ট বলে কিছু নেই। গত কয়েক দিন ভালো করে খেয়াল করলাম, পুলিশের গাড়িগুলোর কোনো চালককে সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালাতে দেখিনি। ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়ে পতাকার দণ্ড লাগানো আছে এমন বড় বড় ও দামি গাড়ির চালকদেরও উল্টো পথে চলতে দেখি নিয়মিতই (এফডিসির সামনে দিয়ে প্রতিদিন কারওয়ান বাজার যেতে হয়, কারওয়ান বাজারে যাবে এমন অনেক গাড়িই উল্টো পথ ধরে)। কাক নাকি কাকের মাংস খায় না, তাও বলি, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্টিকার লাগানো গাড়ি ও ‘সংবাদপত্র’ বা ‘সাংবাদিক’ লেখা গাড়ি বা মোটরসাইকেলের চালকদেরও দেখি ট্রাফিক আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে দম্ভের সঙ্গেই চলাচল করছেন। কার্যকর ব্যবস্থা না থাকলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। কেউই নিয়ম মানছেন না, নিয়ম মানানো যাচ্ছে না।
উড়ালসড়ক আর উড়ালসেতুগুলো তৈরির যে কাজ চলছে, এর পাশাপাশি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের দিকে নজর দিলে সবকিছু মিলিয়েই আমাদের ঢাকা যান চলাচলের ক্ষেত্রে অনেকটাই আধুনিক হয়ে উঠতে পারে। সরকার যদি শুধু হাজার হাজার কোটি টাকার উড়ালসড়ক আর উড়ালসেতু তৈরির নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তবে অবশ্য ভিন্ন কথা। বড় বড় প্রকল্প আর ভাগ-বাটোয়ারার নেশা থেকে মুক্তি পাওয়া সত্যিই কঠিন কাজ।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.