স্মরণ-শহীদ সাবেরের কথা by মযহারুল ইসলাম বাবলা

শহীদ সাবেরের জন্ম ১৮ ডিসেম্বর ১৯৩০ কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁর সোনাপুকুর গ্রামে মাতামহের বাড়িতে। জন্মপরবর্তী ১০টি বছর কেটেছে সোনাপুকুর গ্রামে মায়ের আশ্রয়ে। ঈদগাঁ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। ক্লাসে বরাবরই প্রথম হতেন। তবে তাঁর অভ্যাস ছিল দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা।


যারা সকালে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসত তাদের উদ্দেশে বলতেন, 'ঘুম থেকে আগে উঠলে কী হবে, পড়ায় তোরা কেউ আমার সঙ্গে পারবি না।' গ্রামের স্নিগ্ধ পরিবেশে কাটানো সেই ১০ বছরের স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন, 'আমার জীবনের ১০টি বছর কেটেছে এই গ্রামে।' চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শহীদ সাবেরকে তাঁর মা-ই কলকাতায় বাবা ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সংসারে পাঠিয়ে দেন। কলকাতার সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে বিমাতার সংসারে সব মানিয়ে নিয়েই হেয়ার স্কুলের মেধাবী ছাত্র শহীদ সাবের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ছোটদের আসর, কিশোর সংঘে সক্রিয় সংস্কৃতিকর্মী শহীদ সাবের ছোটদের আসরের গ্রন্থাগারিক ছিলেন। 'ছন্দশিখা' নামে হাতে লেখা পত্রিকার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ। 'ছন্দশিখা'র সম্পাদকও ছিলেন তিনি। এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক 'ইত্তেহাদ'-এ তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল, পরে গল্প ও হরেক রচনাও। দৈনিক ইত্তেহাদে সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি আহসান হাবিব। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, 'অমন সপ্রতিভ ছেলে আমার চোখে পড়েনি। বয়সের তুলনায় তার মানসিক পরিপক্বতা ছিল অনেক বেশি।' ১৯৪৭ সালের দেশভাগে কলকাতা ছেড়ে ফিরে আসেন পূর্ব বাংলায়। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। কলেজজীবনের শুরুতে জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনে সদ্য আজাদিপ্রাপ্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রজুড়ে তখন সাম্প্রদায়িক বিষের দাহ সমাজে বিস্তৃত ছিল। ক্ষমতাসীন লীগ সরকারের প্রধান ও চরম শক্র কমিউনিস্টরা। কমিউনিস্ট দমন-পীড়নে সিদ্ধহস্ত লীগ সরকারের দমন-পীড়নের শিকার ছাত্র ফেডারেশন। সংগঠনের এক সভায় বক্তৃতারত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন শহীদ সাবের। বিনা বিচারে চার বছর তাঁকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে থাকতে হয়েছিল। বন্দিদশায় চট্টগ্রাম জেলে বসে কারাজীবনের রোজনামচা 'আরেক দুনিয়া থেকে' রচনাটি গোপনে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। কলকাতার প্রগতিশীল মাসিক 'নতুন সাহিত্যে'র চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায় জামিল হোসেন ছদ্মনামে লেখাটি প্রকাশিত হয়। লেখাটি উভয় বাংলায় সাড়া ফেলেছিল। কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখে এই নতুন প্রতিভাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। রাজশাহী জেল থেকে ১৯৫১ সালে আইএ এবং মুক্তিলাভের পর ১৯৫৫ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। চার বছর কারাভোগের পর মুক্তিলাভ করেন। কিছুদিন ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে শিক্ষকতার পর যোগ দেন দৈনিক 'সংবাদ'-এ। 'সংবাদ'-এ সম্পাদকীয় লিখতেন এবং দেখতেন সাহিত্য পাতাও। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮_মাত্র এই কটি বছরই নিরবচ্ছিন্নভাবে সক্রিয় ছিলেন সাহিত্য রচনায় ও সাংবাদিকতায়। ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে তাঁর মানসিক সংকট দেখা দেয়। পাবনার মানসিক হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসার ধারাবাহিকতা ও পরিচর্যার অভাবে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। আমৃত্যু পাগলের খ্যাতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ সকালে দৈনিক সংবাদের স্থায়ী বাসিন্দা শহীদ সাবের পাকিস্তানি হানাদারদের বংশালের সংবাদ অফিসে দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যান। সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য রচনার সময় পেয়েছিলেন মাত্র চারটি বছর। ওই চার বছরে তাঁর সব রচনা যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনি শিল্পগুণসমৃদ্ধ। গত ফেব্রুয়ারির বইমেলায় অনুপম প্রকাশনী প্রকাশ করেছে 'শহীদ সাবের রচনাসমগ্র'। শহীদ সাবেরের প্রকাশিত গ্রন্থ_রোজনামচা 'আরেক দুনিয়া থেকে' (১৯৫৭), ছোট গল্পগ্রন্থ 'এক টুকরো মেঘ' (১৯৫৫), কিশোর গল্পগ্রন্থ 'ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান' (১৯৫৮), অনুবাদগ্রন্থ পুশকিনের 'ইস্কাপনের বিবি', গোগলের 'পাগলের ডায়েরী', ক্যাথরিন ওয়েন্স পিয়ারের 'কালো মেয়ের স্বপ্ন' (১৯৫৮)। অসংখ্য কবিতা লিখলেও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭২ সালে ছোটগল্পে (মরণোত্তর) বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল শহীদ সাবেরকে।
মযহারুল ইসলাম বাবলা

No comments

Powered by Blogger.