খোলা হাওয়া-রাষ্ট্র বনাম লিমন হোসেন by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার দুই সাবসিডিয়ারি বিষয়ের একটি ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রাষ্ট্র কী, এর চরিত্র কী, এর নানাবিধ অঙ্গের পরিচিতি এবং কাজ কী—এসব বিষয় গোড়াতেই আমাদের পড়ানো হয়েছিল। সময়টা ছিল পাকিস্তান নামক নিপীড়ক রাষ্ট্রের অন্তিমকালের, যদিও রাষ্ট্রের আচার-ব্যবহারে তার কোনো প্রকাশ দেখা যাচ্ছিল না।


আমরা সেই রাষ্ট্রের ছিলাম দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক নানা সংজ্ঞা আর তার নানাবিধ অঙ্গের আদর্শায়িত বর্ণনার বিপরীতে আমরা বাস্তব যেসব ছবি দেখতে পেতাম, সেগুলো ছিল লোমহর্ষক। ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকলের সুরক্ষা করা’—পাঠ্যবইয়ের এ রকম মধুময় উক্তির মাথায় হাতুড়ি ঠুকে পাকিস্তান রাষ্ট্র তার ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়ে যাচ্ছিল। কোনো বাঙালির জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, কোনো বাঙালির অধিকার বলে কিছু নেই এবং কোনো বাঙালি সুরক্ষার দাবিদার হতে পারে না—এই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকাশ্য অবস্থান। বাংলাদেশে অবশ্য পাকিস্তানের একটি ভৃত্যশ্রেণী ছিল—এখনো আছে—এবং তারা বড় গলায় বলত, পাকিস্তান রাষ্ট্রে সকলেই সমান। বিনিময়ে তারা দু-এক আচমকা বড় পদ, খেতাব, ব্যবসা এসব পেত। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবটি ছিল এই যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র কখনো বাঙালিকে মর্যাদার চোখে দেখত না। ভৃত্যদের তারা প্রশ্রয় দিত বটে, কিন্তু মর্যাদা কদাচ নয়।
তত্ত্ব ও বাস্তবের মধ্যে এ রকম কঠিন অমিল দেখে আমার এক বন্ধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছেড়েই দিল; দিয়ে বাংলা নিল। তাঁর বক্তব্য ছিল, রাষ্ট্র কেতাবে ভালো, বাস্তবে ভয়ংকর। রাষ্ট্রের প্রধান চিন্তা ক্ষমতা—এর সব প্রতিষ্ঠান এবং অঙ্গ ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই তৈরি। এবং ক্ষমতার প্রশ্ন যেখানে বড়, সেখানে শাসন কখনো কল্যাণধর্মী হতে পারে না। শাসন মানেই দমন-নিপীড়ন: শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভাজন ও বৈষম্য, ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার কাছে বিলীন হওয়া। আমার বন্ধুর একটি দার্শনিক উপলব্ধি ছিল এ রকম, রাষ্ট্র হচ্ছে দেশের কাঠামোবদ্ধ, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রূপ। দেশ সবার, রাষ্ট্র সবার নয়। দেশ সবাইকে গ্রহণ করে, রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্র, তাঁর মতে, একটা বিমূর্ত চিন্তা—তার নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই। রাজনীতি তাকে যে রূপ দেয়, সে রূপই সে গ্রহণ করে। এক মাস আগে যে রাষ্ট্রটি ছিল এক বানানা রিপাবলিক, এখন সে হয়তো গণতান্ত্রিক। অথবা উল্টোটি।
বন্ধুটির আরও একটি দার্শনিক উক্তি ছিল এই: রাষ্ট্রের প্রধান চরিত্র ভন্ডামি। রাষ্ট্রের সংবিধান থেকে শুরু করে এর আইনকানুন—সবখানেই ভন্ডামি। এই উক্তি সে বাংলাদেশ হওয়ার আগে করেছে, ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাঁকে গ্রেপ্তার করে দেশদ্রোহের অভিযোগে চরম দণ্ড দাবি করতে পারবে না।

২.
আমার বন্ধুটি নিরাপদ, যেহেতু সে এখন বিদেশে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের ছাড়া কেউ আমরা নিরাপদ নই। ১৯৭১-এ আমরা যুদ্ধ করেছিলাম এক কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য, যে রাষ্ট্র সব নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষা করবে। এই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলেন; কত লাখ জীবন্মৃত হলেন, ইজ্জত হারালেন, প্রিয়জন হারালেন। এই বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেল, একটি চমৎকার সংবিধানও আমরা পেলাম। যে সংবিধান জানাচ্ছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা—যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ এই সংবিধানের ৩৫ ধারার ৫ উপধারায় লেখা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’
একটি রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রধান দিকনির্দেশনা আসে সংবিধান থেকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান একটি অসাধারণ মানবাধিকার দলিল। কিন্তু এতে যা লেখা আছে, বাস্তবে প্রায়ই ঘটে তার বিপরীত। রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত এই সংবিধান লঙ্ঘন করে—সংবিধানের প্রস্তাবনার সেই ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন’ থেকে শুরু করে ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না’ পর্যন্ত। রাষ্ট্র শুধু সংবিধান লঙ্ঘন করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং যখন তাকে দেখিয়ে দেওয়া হয় কোথায় কোথায় এই লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তখন তা নিরসনের পরিবর্তে ছলে-বলে সেগুলোকে বৈধতা দেয়। ফলে লঙ্ঘনের আরও ঘটনা ঘটে। এভাবে একটি অনতিক্রান্ত লঙ্ঘন-বৃত্তে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র।

৩.
এ মুহূর্তে রাষ্ট্র এক অবিশ্বাস্য প্রতিপক্ষ খুঁজে পেয়েছে। তার নাম লিমন হোসেন। বয়স ১৭। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো পাস করে সে এইচএসসিতে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, খরচ চালাচ্ছিল ইটের ভাটায় চাকরি করে। ঝালকাঠির রাজাপুরের একটি কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু এর আগেই ২৩ মার্চ বিকেলে তার পায়ে গুলি করেন র্যাব-৮-এর সদস্য। র্যাব এক সন্ত্রাসী ধরতে ওই গ্রামে গিয়েছিল। না, লিমন হোসেন বন্দুক হাতে ওত পেতে বসে ছিল না, লিমন মাঠে গিয়েছিল গরু আনতে। নিরীহ, ভদ্র, দরিদ্র ছেলে; গ্রামের একজন মানুষও বলেনি, ছেলেটির কোনো দোষ আছে। তার পরও তাকে সন্ত্রাসী বানিয়ে গুলি করা হলো। ২৫ মার্চ ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তার একটা পা কেটে ফেলা হলো। লিমন আর লিমন রইল না। ফ্রানজ কাফকার এক ভয়ানক অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের শুরু এভাবে: ‘এক সুন্দর সকালে মি. কে গ্রেপ্তার হলো।’ ব্যস, তারপর কে-সাহেবের দুনিয়া আর চেনাজানা দুনিয়া থাকল না। এক ভয়ংকর, অনিশ্চিত, অচেনা দুনিয়া হয়ে গেল। লিমনের যেমন হয়েছে। ঘটনার ১৯ দিন পর র্যাবের মহাপরিচালক বললেন, লিমন যে সন্ত্রাসী বা খারাপ ছেলে, তা তিনি বলছেন না। সে ঘটনার শিকার। অথচ এক রাউন্ড গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল ও পাঁচটি রামদাসহ তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। তার পরের ঘটনাগুলো তো সবারই জানা। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো ‘মোটামুটি সুস্থ’ হয়ে গেছে জানিয়ে, যেহেতু রাজাপুর থানায় অস্ত্র আইনে দায়ের করা মামলায় সে আসামি, তাকে ঝালকাঠি নিতে হবে। তারপর ১৬ ঘণ্টা এই হতভাগ্য ছেলেটিকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হলো। ঝালকাঠির আদালতে শুনানি শেষে তাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে নেওয়া হলো বরিশাল শেরেবাংলা হাসপাতালে। শেষ পর্যন্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ লিমনকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে পঙ্গু লিমনের ওপর নির্যাতনের প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চেয়ে রুল জারি করেন মাননীয় আদালত। সরকারি খরচে উপযুক্ত হাসপাতালে তার চিকিৎসার নির্দেশও দেওয়া হয়।
মাননীয় আদালতকে ধন্যবাদ, যে অন্ধকার সুড়ঙ্গে লিমনকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তার দূরমাথায় একটুখানি আলো জ্বেলে দেওয়ার জন্য। এই সুড়ঙ্গটা তাঁর জীবনের সমান দীর্ঘ হবে না তো?

৪.
একটি পা হারানো ছেলে যন্ত্রণায় মাঝেমধ্যেই কাঁদে। তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য তিন-চারজন পুলিশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে মনে হয় সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি হচ্ছে ১৭ বছরের পঙ্গু লিমন! এর অর্থ, হয় লিমন খুবই পরাক্রমশালী—এতটাই যে, ডাক্তার-হাসপাতাল, নিম্ন আদালত সবাই তাকে চিরস্থায়ীভাবে কারাগারে পাঠাতে পারলে বাঁচে। অথবা বাংলাদেশে একমাত্র লিমনই সন্ত্রাসী, বাকি সবাই ফেরেশতা। ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসী নেতা, সাংসদের সন্ত্রাসী পুত্র, টেন্ডারবাজ, খুনি, এসিড-সন্ত্রাসী, ভূমি আর নদীদস্যু, ফতোয়াবাজ—কেউই র্যাবের মনোযোগের মধ্যে নেই শুধু লিমন ছাড়া। সে-ই এ দেশে অপরাধের শেষ বিষবৃক্ষ। অথবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এমন দুর্বল যে, একটি পা হারানো ছোট ছেলের ভয়ে সে দিশেহারা। লিমনের বাবা-মা র্যাবের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। থানা সেই মামলা নেয়নি। অথচ আমার সেই উপহার পাওয়া সংবিধানের ৩১ ধারায় কত সুন্দর করে লেখা আছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ’ প্রত্যেক নাগরিকের ‘অবিচ্ছেদ্য অধিকার’। আদালতের নির্দেশে মামলা নেওয়া হলেও এই মামলায় উৎসাহ নেই। আদালতের উৎসাহ বরং লিমনের বিরুদ্ধে করা অস্ত্র মামলায়। কাগজে লিখেছে, মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপে আছেন লিমনের বাবা-মা।

৫.
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একপর্যায়ে জানালেন, লিমনকে নিয়ে রাষ্ট্রের কিছু করার নেই। কথাটা তিনি কি ঠিক বললেন? তিনি বরং বলতে পারতেন, লিমনের জন্য রাষ্ট্রের ভালো কিছু করার নেই। কিন্তু তাকে পীড়ন করা, কষ্ট দেওয়া, তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কাজে রাষ্ট্রের অনেক কিছু করার আছে।
আমার দার্শনিক বন্ধুর কথা ধার করে বলতে পারি, রাষ্ট্রের কিছু করার নেই, কিন্তু দেশের আছে। লিমনকে নিয়ে রাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই, দেশের আছে। রাষ্ট্রের বিবেক না থাকতে পারে, দেশের আছে। দেশের মানুষের ভোট নিয়ে, পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দল ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু একটি পীড়ক-ব্যবস্থায় লিমনকে ফেলে তার ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে নিতে গেলে পরিবর্তনকামী লিমনের প্রজন্মের অসংখ্য তরুণ আগামী নির্বাচনে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সে দলকে সরিয়ে দেবে। এক লিমন হোসেনের কারণে কত অসংখ্য তরুণ যে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে হিসাবটা নিতে পারলে ভালো হতো।
রাষ্ট্র যত দমন-পীড়ন করবে, অন্যায়কে ন্যায় বলে চালাতে চাইবে—দেশ ততই জাগবে। ততই মানুষ প্রতিবাদী হবে। এ জন্য এ দেশটা নিয়ে আমার এত গর্ব, এত ভালোবাসা—রাষ্ট্র নিয়ে কোনো উচ্চাশা না থাকলেও।
লিমন এ দেশের এক হতভাগা নাগরিক। কিন্তু লিমন একটি শক্তিরও নাম। তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতেও শরীর হিম হয়ে আসে। অথচ সে এখন বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও, আইনকানুনের কানাগলির পাঁকে পড়েও, একটা পা হারিয়েও স্বপ্ন দেখে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার।
হয় লিমন সে সুযোগ পাবে, নয় আমরা সবাই অ-মানুষ হিসেবে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াব। দেশকে যদি ভালোবাসি, তাহলে প্রথম সম্ভাবনাটি আদায় করাই আমাদের কর্তব্য।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.