২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-প্রথম শহীদ মিনার by ডা. সাঈদ হায়দার

কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি, কেউ দুঃখ লয়ে কাঁদে কেউ ভুলিতে গায় গীতি। —কাজী নজরুল ইসলাম আমার এই ৮৬ ছাড়িয়ে ৮৭ বছরের প্রায় জরাগ্রস্ত জীবনে ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে যখন পিছু ফিরে দেখি, তখন মনে হয় অনেক ঘটনার কথা ভুলে গেছি, কিছু কিছু ঘটনার ছবি অস্পষ্ট ঝাপসা আবার এরই মধ্যে রয়েছে কয়েকটা
দিন—দেদীপ্যময় জ্বল জ্বল করছে। ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে সংবেদনশীল একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটি যেমন স্মৃতিতে ভাস্বর, তেমনি অম্লান অবিস্মরণীয় স্মৃতিপটের আর একটি দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি; যেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ছাত্ররা শহীদদের স্মৃতিকে চিরজাগরূক রাখার মানসে এক রাতে নির্মাণ করেছিল প্রথম শহীদ মিনার, যা ভাষা আন্দোলনে যোগ করে এক নতুন দ্যোতনা, নতুন মাত্রা। ভাষা আন্দোলনকে জিইয়ে রাখতে ও আরও বলবান করতে এ ছিল তাদের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধের নিদর্শন।
২২ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল ব্যারাক প্রাঙ্গণে শহীদদের গায়েবানা জানাজার পর শোকাতুর ও ক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার যে মিছিল ফুলার রোড থেকে সদরঘাট পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছিল, তা ছিল আজকের তুলনায় সেদিনের ছোট্ট ঢাকার সর্বকালীন দীর্ঘতম মিছিল। এই মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা যেসব প্ল্যাকার্ড বহন করে, তাতে যেমন লেখা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানব না,’ ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই,’ ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’—তেমনি এদের মধ্যে দেখা দেয় একটা নতুন স্লোগান ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। এই স্লোগান বুকে ধরা কয়েকটি পোস্টার হোস্টেলের খাপাচির বেড়াতেও সাঁটা দেখা যায়।
২৩ ফেব্রুয়ারির রাতে শহীদ মিনার গড়ার ধারণাটা সম্ভবত সূচিত হয় উপরিউক্ত স্লোগানের বাণী থেকেই এবং ধারণাটা ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করে। গোপন সিদ্ধান্ত হয়—শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ওই রাতেই অতি সন্তর্পণে গড়তে হবে একটি ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। এ বার্তা গোপনীয়তার সঙ্গে পৌঁছে যায় সব ছাত্রকর্মীর কাছে ফিসফিস করে কানে কানে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ যত সহজ, বাস্তবায়ন তো তত সহজ নয়। নির্মাণসামগ্রী কোথায়? ওস্তাগর আসবে কোথা থেকে? কোনখানে গড়তে হবে? অভীষ্ট স্থাপনার নকশা কোথায়? এত সব নেতিবাচক প্রশ্নের সামনে এই পরিপ্রেক্ষিতে যে বস্তুটির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তার কোনো অভাব ছিল না—তা হলো ব্যারাকবাসী ছাত্রকর্মীদের মানসিক প্রস্তুতি, দৃঢ়সংকল্প ও কর্মোদ্যম।
ইতিমধ্যেই কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা স্মৃতিস্তম্ভের স্থান নির্দিষ্ট করেছিল, ব্যারাক হোস্টেলের ফুলার রোড থেকে যে দীর্ঘ আধাপাকা সরু রাস্তা দুই সারি ব্যারাকের মাঝ দিয়ে বকশীবাজার সড়কে গিয়ে মিশেছে, প্রধান ফটক পেরিয়ে এ পথ ধরে কয়েক গজ যেতে ডান হাতে ১২ নম্বর ব্যারাকের প্রায় সোজাসুজি ওই স্থান, যেখানে প্রথম শহীদের লাশ পড়েছিল, তারই সন্নিকটে।
অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে যে ঢাকাইয়া বা পুরান ঢাকার অধিবাসীরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। আন্দোলনের ১৯৪৭-৪৮ সালের পর্যায়ে এই কথা আংশিক সত্য হলেও বায়ান্নর আন্দোলনের জন্য মোটেই সত্য নয়; এই আন্দোলনের চরম পর্যায়ে তারা ছাত্রজনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিটিং-মিছিল করেছে, লড়েছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ঢাকাইয়া ঠিকাদার পিয়ারু সর্দার তাঁর গুদামের চাবি না দিলে প্রথম শহীদ মিনারের নির্মাণসামগ্রী কোথায় পেতাম? আর গোপন তৎপরতার মধ্য দিয়ে এই প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে যে দুজন রাজমিস্ত্রির নিপুণ হাতের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছিল, তারাও ছিল ঢাকাইয়া। আন্দোলনের জন্য এই সময়োচিত সাহায্য সেদিন আমাদের জন্য ছিল শ্রেষ্ঠ কাম্য সহায়তা।
আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু বদরুল আলম ভালো ছবি আঁকতে পারত। সে যে নকশাটা নিয়ে এল, তা অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কিন্তু এক রাতে গড়া সম্ভব নয়। আমি একটি সাদামাটা খসড়া স্কেচ দেখলাম: স্বল্প কথায়, মাটির পাঁচ ফুট গভীরে প্রোথিত এর বেদি—যার উপরিতল মাটির এক ফুট ওপরে; বেদির ওপরে একটা ছয় ফুট মাপের ঘনক্ষেত্র বা কিউব; কিউবের উপরিতলকে দুটো ভাঁজ দিয়ে ছোট করে এনে একটা চৌকোক্ষেত্র; এর ওপর একটি প্রলম্বিত পিরামিড আকারে মিনারের ওপরাংশ, যার চূড়া শেষ হয় মাটি থেকে ১১ ফুট উঁচুতে উঠে। নেতা ও কর্মীদের খসড়া স্কেচটা পছন্দ হলো। বদরুল ও আমি ঘরে ফিরে এলাম প্ল্যানটা চূড়ান্তভাবে কাগজে আঁকতে।
সান্ধ্য আহারের পর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যারাকবাসী ছাত্ররা হাতে হাতে ইট বয়ে এনেছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে রক্ষিত ইটের স্তূপ থেকে। ঠিকাদার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে স্ট্রেচারে করে তারাই এনেছে সিমেন্ট আর বালু, ছাত্ররাই হোস্টেলের ট্যাপ থেকে বালতিভর্তি পানি টেনে এনেছে, বালু-সিমেন্টের মর্টার তৈরি করেছে নিজ হাতে, নিয়োজিত দুজন রাজমিস্ত্রির সহকারী হয়ে কাজ করেছে—অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে রাতভর বাইরের কারফিউ এড়িয়ে আর হিমেল হাওয়াকে উপেক্ষা করে। ভোরের রক্তিম আলো ফুটে ওঠার আগেই অবাক-বিস্ময়ে মানুষ দেখল দুই মানুষ উঁচু ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার স্মৃতি নিয়ে বলতে পারি যে এই প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নির্মাণ সমাপ্তির সব কৃতিত্ব সেদিনের ব্যারাক হোস্টেলের সব ছাত্রের। মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের ভিপি ও জিএস—গোলাম মাওলা ও শরফুদ্দিনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে— ছাত্রদের প্রাণের আবেগ, সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও যৌথ শ্রমে গড়ে ওঠে এই প্রথম শহীদ মিনার।
স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এই মিনারের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা নগণ্য। দৃঢ় সবল দেহ আর মাথা নত না করা প্রতিবাদী উন্নত শির। কিন্তু এই স্থাপত্যকর্মটিই সেদিন এক অসাধ্যসাধন করল। ত্বরিতগতিতে শহরময় পৌঁছে গেল মিনারের খবর। ছুটে এল দলে দলে মানুষ শহীদ মিনারের পাদদেশে, এল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, ছোট শিশুর দল শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে—ফুলে ফুলে ছেয়ে দিল মিনারের বেদি। যে আন্দোলন প্রায় সীমাবদ্ধ ছিল ছাত্রসমাজের মধ্যে—প্রথম শহীদ মিনার তাকে পরিণত করল এক গণ-আন্দোলনে।
নির্মাণ শেষ হওয়ার আগে প্রথম শহীদ মিনারের অমিত শক্তির কথা আমরা চিন্তা করিনি, বুঝতে পারিনি, কিন্তু বুঝেছিল দুর্বিনীত নুরুল আমীন সরকার। তাই ২৬ ফেব্রুয়ারির শেষ বিকেলে তার পেটোয়া পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ধ্বংস করে ফেলে এই প্রথম শহীদ মিনার এবং অপসারিত করে এর শেষ চিহ্নটুকু। এ এখন স্মৃতির মিনার, কিন্তু এর উত্তরসূরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, যা যুগের পর যুগ ধরে আমাদের প্রতিবাদী হতে শেখায় অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে, সংশয় ও সংকটে ডাক দেয় সম্মিলিত সংগ্রামের, অনুপ্রাণিত করে প্রতিটি শুভ কাজে।

No comments

Powered by Blogger.