মেধাশূন্য ছাত্ররাজনীতিঃ ‘এ আমার এ তোমার পাপ’

আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে পড়েছে বলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের এমপির কণ্ঠে যে হাহাকার সোমবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে শোনা গেল, এ ধরনের মন্তব্য অনেকেই করে থাকেন।
তবে স্বচ্ছ ও সত্ চিন্তার ক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে পড়লেও বহুমুখী অপরাধে চূড়ান্ত ‘সাফল্য’ অর্জনের ক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতির নামে মেধার যে চমত্কারিত্ব বছরের পর বছর প্রদর্শিত হয়ে আসছে, তাতে গোটা জাতি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ছাত্ররাজনীতি যে এখন আতঙ্কের প্রতিশব্দে রূপান্তরিত হয়েছে, এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, মেধাবীরা ছাত্ররাজনীতিতে আসছে না। আর মেধাবীরা ছাত্ররাজনীতিতে না এলে দেশ ও জাতি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে। এ কথা বলে তিনি নিশ্চয়ই বোঝাতে চেয়েছেন যে, সেক্ষেত্রে দেশ ও জাতি যোগ্য নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগবে।
ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল ভাবমূর্তি হারিয়ে গিয়ে নেতিবাচক রূপ পরিগ্রহ একদিনে হয়নি। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে মোনায়েম খান তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর থাকাকালে পেশিশক্তি ও অবৈধ অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে বিপথগামী করার স্থূল চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু ঊনসত্তরের ছাত্র-গণআন্দোলনকালে মোনায়েম খানের দুধ-কলায় পুষ্ট ছাত্রসংগঠন এনএসএফের বৃহত্তর অংশ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয় এবং সরাসরি আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। এর আগে ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে নস্যাত্ করার জন্য তত্কালীন সরকার প্রথম কাতারের কয়েকজন ছাত্রনেতাকে পুরস্কৃত করে ছাত্ররাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। তাতে যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি—বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সাফল্যই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। পাকিস্তান আমলে প্রবল বিরুদ্ধ স্রোত যে-ছাত্ররাজনীতিকে বিপথগামী করতে পারেনি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাতে এমনভাবে পচন ধরে গেল কেন—সে প্রশ্নের সদুত্তর আমাদের পেতেই হবে। ওবায়দুল কাদের যেদিন ঢাকায় ছাত্রলীগের উত্সব মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছাত্ররাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে পড়েছে বলে বিলাপ করছিলেন, সেই একইদিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে কমপক্ষে তিনজন আহত হয়েছে। না, কোনো আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে এ সংঘর্ষ ঘটেনি। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও উদযাপিত হয়েছে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উত্সব। কিন্তু উত্সব শেষে চা খাওয়াকে কেন্দ্র করে লেগে গেছে ধুন্ধুমার কিলাকিলি। কপাল ভালো, এ হাঙ্গামায় লাঠি ছাড়া কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। তাই ‘মাত্র’ তিনজনের মাথা ফাটার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে।
ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে পাওয়া ও খাওয়ার নেশা এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে যে, চা খাওয়া নিয়ে মারামারি এখন আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে নিজের সবকিছু উজাড় করে দেয়ার মানসিকতা ছাত্ররাজনীতি থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। তাই এখন ছাত্ররাজনীতি থাকলেও ছাত্র আন্দোলন নেই। অথচ ছাত্ররাজনীতির গৌরবের দিনগুলো নিয়ে যারা হাহুতাশ করেন, তাদের মনে রাখা উচিত যে, সে সময়ে ছাত্র আন্দোলন ছিল মুখ্য। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা ছাত্ররাজনীতি করে বলে পরিচিতি পেত। পুলিশের সঙ্গে, এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে ছাত্রআন্দোলনের ছিল দা-কুমড়া সম্পর্ক। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে পুলিশ, আমলা, মন্ত্রীদের দহরম-মহরম ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। এই মাখামাখি যেদিন থেকে প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্ররাজনীতির অবক্ষয়ের যুগ। ছাত্রসংগঠনকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করে, ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের দলাদলির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলে আমরা পচনের এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করেছি। আজ ছাত্ররাজনীতির নামে দেশব্যাপী যে নৈরাজ্য চলছে, তার জন্য আমাদের কারও দায় কারও চেয়ে কম নয়। আসলে আমাদের অসুস্থ জাতীয় রাজনীতিতে যারা সামনের কাতারে ভিড় করে আছেন, তারা নিজেদের মালিন্যের কারণে তারুণ্যের সংগ্রামী চেতনাকে ভয় করেন। তরুণদের এই চেতনা ধ্বংস করার জন্য ছাত্ররাজনীতিকে পচিয়ে ফেলা হয়েছে; নামিয়ে আনা হয়েছে পাওয়া এবং খাওয়ার হাতিয়ারের পর্যায়ে। স্থূল ভোগের জন্য কারও না কারও হাতিয়াররূপে ব্যবহৃত হতে মেধা লাগে না। এখনকার ছাত্ররাজনীতিতে মেধার আগমন ঘটবে কেন?

No comments

Powered by Blogger.