বাংলা আমার অহংকার by আমজাদ হোসেন

প্রাণিবিজ্ঞান তো বলে, শিশু মাতৃগর্ভে পাঁচ মাস বয়সে যখন পেঁৗছায়, তখনই সে মায়ের ভাষা, মায়ের কথোপকথন শোনার ক্ষমতা অর্জন করে। সে জন্যই কি বাংলা ভাষা এই পৃথিবীর সব ভাষার চেয়ে আমার কাছে প্রিয়? আমার যখন জন্ম হয় তখনই আমি একটা চিৎকার দেই, সেই চিৎকারও বাংলা ভাষার আর্তনাদের মতো শোনায়।


আমি কিন্তু মাটিতে পা ফেলার আগে মা-বাবাকে ডাকতে শিখি। তারপর আমার শুরু হয় হাঁটি হাঁটি পা পা।
'আমি বাংলায় কথা বলি, আমি বাংলায় গান গাই।' বাংলা ভাষা আমার মা। বাংলা ভাষার যখন আন্দোলন শুরু হয়, আমি তখন কিশোর। আন্দোলন কী বুঝতাম না। ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার বড় ভাইয়েরা তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। এক দুপুরে তারা কয়েকজন জামালপুরে এসে আমাদের সবাইকে মাইকে ডেকে ডেকে স্কুল থেকে বের করেন। আমরা সবাই বেরিয়ে আসি। আমাদের শহরের রাস্তাটা ছিল সিমেন্ট কংক্রিটের। আমাদের সবাইকে রাস্তায় বসিয়ে দেওয়া হলো বই-পুস্তক দিয়ে এবং আমাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটি করে চক পেনসিল। আমাদের শুধু বর্ণমালা লিখতে হবে রাস্তাজুড়ে। বড় ভাইদের হুকুম হলো_ এই রাস্তা দিয়ে এসডিও, সার্কেল অফিসাররা যেন গাড়ি নিয়ে যেতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
আমরা যেন বর্ণমালার আলপনা আঁকছি রাস্তাজুড়ে। অ আ ক খ লিখতে লিখতে হঠাৎ শুনলাম একটি গান_ 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়'।
গান শুনে মায়ের কথা মনে পড়ল। দু'চোখে মায়ের জন্য জল এলো। মনে মনে বললাম, আমার মাকে এত কষ্ট দিতে চায় কারা? সেই কিশোর বয়সেই রক্ত গরম হয়ে গেল। আমি যেন মায়ের জন্য মরতে পারি, এমন একটা প্রচণ্ড আবেগে অস্থির হয়ে গেলাম।
তারপর তো বরকত, সালাম, রফিক, শফিউর, জব্বার সেই সব রক্তাক্ত থোকা থোকা নাম সারাদিন ধরে আমাকে আবেগের মধ্যে রেখেছে। তাদের সেই মৃত্যুঞ্জয়ী আত্মত্যাগের কারণে আজ সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকার হয়েছি।
ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার উৎসমুখ। আমরা যে বাঙালি, এই কথাটা যেন বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে গেল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই ভাষা আন্দোলনের কারণেই ঘুমন্ত জাতি জেগে উঠেছিল। মিছিলে মিছিলে ভরে গিয়েছিল সারাদেশ। তারপর স্বাধিকারের আন্দোলন শুরু। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আসাদ, মতিউর গুলিতে শহীদ হলেন। বাংলার মানুষ কারফিউ ভেঙে গণজোয়ার সৃষ্টি করলেন। তারপর শুরু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তিরিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। কিন্তু মা আমার বাংলা ভাষা মলিন এবং অবহেলিতই রয়ে গেলেন। শুধু অবহেলা নয়, নাটক-সিনেমা, দোকানে, দোকানের সাইনবোর্ডে বিকৃত ভাষার আর অমার্জনীয় ভুল বানানের ব্যবহার দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত ভাষা। আমাদের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তারপরও সরকার আসে যায়, গালভরা অসংখ্য প্রতিশ্রুতি শোনায়। কিন্তু এই বিকৃতি বোধের জন্য কোনো রকম পদক্ষেপ নেয় না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষাও চালু করতে পারেনি কেউই। মাগো, সরকার কিছু করুক বা না করুক, আমরা কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-অভিনেতারা তোমাকে কখনও মলিন-বিষণ্ন হতে দেব না। মা, তোমার মুখের বুলি আমার অহংকার। তোমার কথার বাগানে আমরা ফুল ফোটাবোই। মাগো, দেশের এই অস্থির অবস্থা দেখে তুই কিন্তু কাঁদিস না মা। তোর অফুরন্ত সৌন্দর্যময় ভাষার ব্যবহারে একদিন সবাই ফুলের মতো সুন্দর হবে, হবেই। অসুস্থ রাজনীতি তোর পায়ে পড়ে কাঁদবে।
মাগো, আমরা তোর শান্ত ছেলে, প্রয়োজনে আবার রুখে দাঁড়াব। একদিন তোর হৃদয়ের কথা বাংলা ভাষাকে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলব।

আমজাদ হোসেন : নাট্যব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.