২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-১৪৪ ধারা ভঙ্গ by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুব থমথমে মনে হয়েছিল। কী রকম একটা বিপৎসংকেতের মতো শোনাচ্ছিল সরকারি গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ পরিবেশনটি। যখন শুনলাম, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই।


মনে হয়েছিল, আমাদের আন্দোলনকে কারা যেন বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাত নয়টা-দশটার সময় আমরা সাত-আটজন বন্ধুবান্ধব মিলিত হই ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব পাড়ে। যত দূর মনে পড়ে, সেখানে মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মমিন, জিল্লুর রহমান, কমরুদ্দিন শহুদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার মুকুল উপস্থিত ছিলেন। অনেক পরে শুনেছি, ওই বৈঠকে একজন গুপ্তচরও উপস্থিত ছিলেন। আমি এখন তাঁর চেহারা মনে করতে পারছি না। ওই সভায় একটা প্রশ্ন ওঠে, বিনা প্রস্তুতিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে অযথা শক্তিক্ষয় করা হবে কি না। মুসলমান ছাত্রসমাজে আইন ভাঙার তেমন রেওয়াজ ছিল না বললেই চলে। আমরা কেমন করে আইন অমান্য করব, তার কোনো স্পষ্ট ছবি তখন আমাদের মনে ছিল না। তরুণ মনে এই আশা ছিল যে একবার ১৪৪ ধারা ভাঙলে বেশির ভাগ ছাত্রই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য। পরের দিন সকালে আমি আর মোহাম্মদ সুলতান জগন্নাথ কলেজ ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি স্কুলে গেলাম ধর্মঘট কেমন চলছে দেখার জন্য। নবাবপুরে আওয়ামী লীগের অফিসে একবার ঢুঁ মেরে দেখলাম, ১৪৪ ধারা ভাঙা উচিত হবে কি না এই নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। শহরে তখন একটা উত্তেজনার ভাব। আর্টস বিল্ডিংয়ে ফিরে এসে দেখি, মিটিং শুরু হয়েছে। গাজীউল হক দুই হাত তুলে সভা পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শামসুল হক সাহেব নিজের অনেক কথা বলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করলেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের কনভেনার আবদুল মতিন সাহেব অত্যন্ত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে প্ল্যান দিলেন যে একসঙ্গে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে পারে। সুতরাং ১০ জন ১০ জন করে ছোট ছোট দল এগিয়ে যাবে ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য। গাজীউল হক সেই পরিকল্পনাকে সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা করলেন। উত্তেজনায় জমায়েত ফেটে পড়ল। ভাইস চ্যান্সেলর মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব সবাইকে একবার শান্ত করার চেষ্টা করলেন। আইন ভাঙার পরিকল্পনায় এমন একটা অতর্কিত ভাব ছিল যে অনেকে ভালো করে বুঝতে পারল না, কী করতে হবে। আগের রাতে যাঁদের মধ্যে আইন ভাঙার ব্যাপারে একটু ইতস্তত ভাব ছিল, দেখলাম, তাঁদের সেই দোটানা ভাব কখন কেটে গেছে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছাড়বে বলে অনেকে রুমাল ভিজিয়ে নিল। ভিড়ের মধ্যে আমিও আমার রুমালটা ভিজিয়ে নিলাম। তার জন্য মনে কেমন যেন একটা লজ্জা হচ্ছিল। প্রক্টরের গেটের কাছে ক্রমশ ভিড় জমেছে, কিন্তু রাস্তায় বের হওয়ার কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। চতুর্দিকে একটা বিশৃঙ্খলার ভাব। কেউ কারও কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি দেখলাম, আমাদের আগের দিনের প্ল্যান প্রায় ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমরা কয়েকজন যদি গেটের বাইরে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙি, তবে কেমন হয়। আমাকে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে—এমন কোনো পূর্বসিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে আমার মনে নেই। আমি যেহেতু আগের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙার ওপর জোর দিই, সে জন্য বন্ধুদের একটা প্রত্যাশা ছিল যে আমি প্রথমে ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে যাব। যাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে এলেন, মোহাম্মদ সুলতান তাঁদের নাম লিখে নিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘তুই আমার পঙ্খিরাজটা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।’ গলা ফাটিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম কয়েকজনকে সঙ্গে করে। তখন বেলা সোয়া একটা।
উত্তেজনায় সারা গা থেকে তখন আগুনের ভাপ বের হচ্ছে। প্রথমে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং পরে রাস্তার একধারে ঘেরাও করে রাখে।
কলাভবনের ওপর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখলাম, আমার দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু দোতলা থেকে আমাদের লক্ষ করছে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর যখন অন্য ছাত্ররা গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করল, তখন আমাদের কয়েকজনকে পুলিশ একটা ট্রাকে তুলে নিল। ট্রাকটা যখন তেজগাঁওয়ের দিকে চলতে শুরু করল, তখন মনের অবস্থা হালকা করার জন্য আমি বললাম, ‘দূরে কোথাও কোনো মজা পুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলা হবে।’ ট্রাকটা চলার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ায় মানসিক উত্তেজনা কিছু কমল, কিন্তু দুর্ভাবনা বাড়তে থাকল। অবশেষে আমাদের তেজগাঁও পুলিশ স্টেশনে হাজির করা হলো। ছোট্ট একটা হাজতঘরে আমাদের ১০-১২ জনকে একসঙ্গে আটকে রাখা হলো। হাজতঘরে আরও দু-একজন আসামি ছিল। ঘরে প্রস্রাবের গন্ধে টিকতে না পেরে আমরা চেঁচামেচি করি। পরে আমাদের বড় একটি খোলা ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। রাতে দারোগা সাহেবের অফিসঘরে মাটিতে শোয়ার জন্য ঢালাও বন্দোবস্ত করা হলো। পোড়া খিচুড়ি খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ রাত তিনটায় ঘুম ভাঙল। ফিসফিস করে কানাকানি করছে সবাই। শুনলাম, ঢাকায় গুলি চলছে। ধীরে ধীরে কথাটা প্রত্যেকের কানে পৌঁছাল। অল্প শক্তির একটি ঘোলাটে বিজলি বাতির আলোয় বড় ঘরটার আবহাওয়া ক্রমেই ভারী হয়ে উঠল। সকালে আমাদের পুলিশভ্যানে করে ঢাকা কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। রাস্তা একবারে জনশূন্য। সব খাঁ খাঁ করছে। কোর্টে পৌঁছে দেখি, কোর্ট চত্বরে লোক গিসগিস করছে। পুলিশ আর সেনাবাহিনী চারধার ঘিরে রেখেছে। জনতার মধ্যে থেকে কেউ কেউ আমাদের জন্য কিছু খাবার এনে দিলেন। বন্ধুদের পরামর্শে অবাঙালি পুলিশ ও সৈন্যদের উদ্দেশে উর্দুতে কয়েক মিনিট বক্তৃতা করার চেষ্টা করলাম। কয়েকখানা মর্নিং নিউজ পত্রিকাও পোড়ানো হলো। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কোর্টে হাজির না করেই আমাদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নেওয়া হলো। পরে শুনলাম, খুনের চেষ্টা, মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র সহকারে দাঙ্গা, কর্তব্যরত সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে হামলা ইত্যাদি অভিযোগে আমাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিচারাধীন কয়েদির নম্বর ৪৭৭ হলো আমার পরিচয়। বেশ কয়েক দিন পর জেলের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে আমাদের হাজির করা হলো। আমরা এই বলে সাফাই দিলাম যে ‘১৪৪ ধারা অন্যায়ভাবে জারি করা হয়, সেইভাবে আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি।’ যত দূর মনে পড়ছে, আমি ১১ই মার্চ জেল থেকে বেরিয়ে আসি।
জেলে আমাদের কোনো ক্লাস দেওয়া হয়নি। একটা লম্বা ঘরে ২৭-২৮ জন মিলে আমরা রাত কাটালাম। আমাদের প্রত্যেককে দুটো করে কম্বল দেওয়া হয়। আমার এক পার্শ্বে থাকতেন এস এ বারি এ.টি. আরেক পাশে নেয়ামাল বাসির। ইকবালের একটা কবিতার বই থেকে নেয়ামাল বাসির কবিতা পড়ে শোনাতেন। দু-একবার আলোচনা চক্রের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই আবহাওয়ায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জেলের মধ্যে নানা ধরনের স্লোগান দেওয়া হতো। ‘নূরুল আমীন গদি ছাড়’—এই স্লোগানটা তখন আমরা তেমন পছন্দ করতাম না। আমাদের কেমন একটা আশঙ্কা হতো যে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কেউ আবার বাংলা ভাষার আন্দোলনকে বিপথে চালিত না করে। পুলিশের ভয়ে লোক এত অতিষ্ঠ ছিল যে আমার বন্ধুবান্ধব কেউ আমার সঙ্গে জেলে দেখা করতে আসতে পারেনি। রাজশাহী থেকে আব্বা এলেন দেখা করার জন্য। জেলখানার কম্বল গায়ে দিয়ে দাড়িভরা মুখ নিয়ে যখন তাঁর সামনে গরাদের এ পাশে দাঁড়ালাম, তখন দেখি তাঁর চোখ ছলছল করছে। আমি অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলাম। পিতা-পুত্রের মধ্যে প্রায় কোনো কথাই হলো না। ‘কারাবরণ’ কথাটার মধ্যে একটা ব্রত উদ্যাপনের ভাব আছে, আত্মনিগ্রহ ব্রতের। জেল আমার ভালো লাগেনি।
জেল থেকে বেরিয়ে আমি রাজশাহী যাই। কয়েক সপ্তাহ পরে ঢাকায় ফিরে আসি। ল’য়ের একটা ক্লাস তখনো বাকি ছিল। পয়লা মে আমার শিক্ষক প্রফেসর হালিম সাহেবের আমন্ত্রণে ইতিহাস বিভাগে অস্থায়ী লেকচারার পদে যোগদান করি। আমার হাজতবাসের কথা উল্লেখ করে ভাইস চ্যান্সেলরের শিগগিরই কান ভারী করা হয়। কোনো কোনো সহযোগী আমাকে বিশেষ বর্ণে রঞ্জিত করে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে অভিযোগ করেন। ৪ মে প্রফেসর হালিম আমাকে ডেকে সব কথা বললেন। তাঁকে চিন্তান্বিত দেখে আমার খারাপ লাগল। আমি বললাম, ‘আমার জন্য যদি আপনার বা ইউনিভার্সিটির কোনো অসুবিধা হয়, তবে আমি পদত্যাগ করছি।’ অনুরূপ ভাষায় তাঁকে একটি পদত্যাগপত্র দিলাম। ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে কয়েক বছর সিরাজগঞ্জ কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজশাহী কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপনা করি। ১৯৫৬ সালে স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ড যাই ইতিহাসে অনার্স পড়তে।

No comments

Powered by Blogger.