একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ by মাহবুবুল হক

বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়েছিল শতবর্ষেরও আগে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ বরেণ্য বাঙালি এ ধরনের ব্যাকরণ রচনার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন বিশ শতকের গোড়ায়। রবীন্দ্রনাথ নিজে কিছু কাজও করেছিলেন।


এরপর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু হলেও বাংলা ভাষার স্বকীয় ব্যাকরণ লেখার কাজটি অসম্পন্নই থেকে যায়। আমাদের সৌভাগ্য, বাংলাদেশের জাতীয় বিদ্বৎ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী বহু-আকাঙ্ক্ষিত এ কাজ সম্পন্ন করেছে। সম্প্রতি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রকাশ করে পালন করেছে এক ঐতিহাসিক কর্তব্য।
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের স্বপ্নদর্শী ও সাহসী উদ্যোগের ফসল এ ব্যাকরণ। এ ব্যাকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের জুনে। আগস্টে বাংলা একাডেমীতে দুই দিনব্যাপী ‘বাংলা ব্যাকরণ’ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ব্যাকরণবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির সহযোগিতায় কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় দুই দিনব্যাপী আলোচনাচক্র। এপ্রিলে বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচিত লেখকদের নিয়ে কর্মশালা। তারপর দেড় বছর ধরে চলে লেখা ও সম্পাদনার কাজ। ২০১০-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় বহু আকাঙ্ক্ষিত এ ব্যাকরণ।
প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ দুটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ড রয়েছে পাঁচটি পর্বের। প্রথম পর্বে ধ্বনিবিজ্ঞান অংশে দেখানো হয়েছে বাংলা স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ-প্রক্রিয়া ও তরঙ্গ-ধ্বনিচিত্র।
দ্বিতীয় পর্বের আলোচ্য বিষয় ধ্বনিতত্ত্ব। এ অংশে দেখানো হয়েছে:
১. বাংলা বর্ণমালায় বর্তমানে এগারোটি স্বরবর্ণ ব্যবহূত হলেও প্রমিত বাংলায় স্বরধ্বনির সংখ্যা সাতটি।
২. বাংলা বর্ণমালায় ঊনচল্লিশটি বর্ণ ব্যবহূত হলেও প্রমিত ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা আটাশটি।
৩. প্রমিত বাংলায় অর্ধস্বরের সংখ্যা চারটি এবং যথার্থ দ্বিস্বরের সংখ্যা সতেরোটি।
এ ছাড়া এ অংশে বাংলা যুক্তব্যঞ্জনের প্রকৃতি, ধ্বনিদল সংগঠন, সঞ্জননী ধ্বনিতত্ত্ব, ধ্বনির স্বলক্ষণ, অধিধ্বনি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্বের আলোচ্য বিষয় রূপতত্ত্ব। শব্দ নির্মাণের রূপতত্ত্বে আলোচিত হয়েছে প্রত্যয় যোগে এবং সমাস ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় বাংলা শব্দ গঠনের প্রসঙ্গ। পদ গঠনের রূপতত্ত্বে নিরূপণ করা হয়েছে বিভক্তি যোগে পথ গঠনের বৈশিষ্ট্য। আলোচিত হয়েছে বিশেষ্য ও সর্বনাম শব্দের কারকাশ্রিত রূপ এবং ক্রিয়াপদের রূপ গঠনের প্রকৃতি। প্রথাগত ব্যাকরণের মতো সংস্কৃত ব্যাকরণের শব্দ নির্মাণের বিষয়টি এতে ঠাঁই পায়নি, প্রমিত বাংলার শব্দ গঠনের প্রকৃতিই গুরুত্ব পেয়েছে। প্রথাগত ব্যাকরণে বাংলা ভাষার পাঁচ ধরনের শব্দশ্রেণীর কথা বলা হয়। এ ব্যাকরণে বাংলা ভাষার শব্দশ্রেণীকে আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অব্যয় বলে যে শ্রেণীটির কথা প্রথাগত ব্যাকরণে বলা হয়, তা ভাষাবিজ্ঞানসম্মত নয় বলে বর্জিত হয়েছে। এ ছাড়া রূপতত্ত্ব অংশে শব্দদ্বিত্ব, বচন, বহুশাব্দিক ক্রিয়া, লগ্নক, বাগ্ধারা ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। বাংলায় অর্থগত লিঙ্গ থাকলেও ব্যাকরণিক লিঙ্গ নেই। তাই রূপতত্ত্বে লিঙ্গের আলোচনা বাদ গেছে।
চতুর্থ পর্বের বিষয় বাক্যতত্ত্ব। এ অংশে আলোচিত হয়েছে বাক্যের উপাদান, বাক্যের গঠন-প্রক্রিয়ায় সেগুলোর ভূমিকা, বাক্যের গঠনগত ও ভঙ্গিগত নানা ধরন, বাক্যের পদক্রম, বাক্যে উপাদানের লোপ, বাচ্য ইত্যাদি।
পঞ্চম পর্বের আলোচ্য বিষয় বাগর্থতত্ত্ব ও ব্যঞ্জনাতত্ত্ব। বাগর্থতত্ত্বে আলোচিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদপ্রতিবেশে শব্দের অর্থগত ভিন্নতা। আর ব্যঞ্জনাতত্ত্বে দেখানো হয়েছে তির্যক অর্থ প্রকাশে বাক্যের শব্দ ও পদবন্ধের ব্যবহার।
প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের দ্বিতীয় খণ্ড চারটি পর্বে বিভক্ত। এ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলা ভাষার ব্যাকরণের বিভিন্ন আনুষঙ্গিক দিক। প্রথম পর্বের বিষয়: বাংলা ভাষা ও লিপির বিবর্তনের ইতিহাস, বাংলা ব্যাকরণ ও এর পরিভাষা নির্মাণের ইতিহাস। দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে বাংলার সঙ্গে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, তিব্বতি-বর্মি ভাষাগোষ্ঠী এবং সংস্কৃত, আরবি-ফারসি ও ইংরেজি ভাষার সম্পর্কের বিভিন্ন দিক। তৃতীয় পর্বে আলোকপাত করা হয়েছে উপভাষা-ভূগোল, সমাজভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষা সম্পর্কে।
চতুর্থ পর্বের আলোচিত বিষয়: আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপি ও রোমান হরফে বাংলার প্রতিবর্ণীকরণ, আরবি-ফারসি হরপের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ, যতিচিহ্ন, বর্ণক্রম, কাব্যভাষার ব্যাকরণ ও ভাষাপরিকল্পনা।
এ ব্যাকরণ রচনার কাজে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ব্যাকরণবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা হলেন: পবিত্র সরকার, রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনিরুজ্জামান, অনিমেষকান্তি পাল, সুভাষ ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, কাজী রফিকুল হক, রাজিয়া সুলতানা, সুনন্দকুমার সেন, বেগম জাহান আরা, কৃষ্ণা ভট্টাচার্য, মহাম্মদ দানীউল হক, অশোক মুখোপাধ্যায়, আবদুস সবুর খান, অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, মাহবুবুল হক, মীনা দাঁ, জীনাত ইমতিয়াজ আলী, স্বরোচিষ সরকার, ফিরোজা ইয়াসমিন, গুলশানআরা বেগম, তপতী সরকার, সৌরভ সিকদার, অশোক বিশ্বাস, মো. শরিফুল ইসলাম, শাহরিয়ার রহমান, শিশির ভট্টাচার্য্য, সাখাওয়াৎ আনসারী, এম মনিরুজ্জামান ও রাজীব চক্রবর্তী।
এ গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন রফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকার। সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন মাহবুবুল হক, জীনাত ইমতিয়াজ আলী, স্বরোচিষ সরকার ও রাজীব চক্রবর্তী। উপদেষ্টা ছিলেন আনিসুজ্জামান ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন আবদুল ওয়াহাব।
এ ব্যাকরণ পাঠ্যবই হিসেবে রচিত হয়নি। বাংলা ভাষার নিজস্ব ধ্বনিপদ্ধতি এবং প্রসঙ্গ-প্রক্রিয়াগুলো নিরূপণ ও বর্ণনাই এ ব্যাকরণের লক্ষ্য। এদিক থেকে এর প্রকৃতি আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাকরণের। বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত যত ব্যাকরণ রচিত হয়েছে, সবই ছিল ব্যক্তিগত প্রয়াসের ফল। এদিক থেকে এ ব্যাকরণ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও সমবেত প্রয়াসের অনবদ্য স্বাক্ষর। গোটা বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সাফল্য।

No comments

Powered by Blogger.