চরাচর-বর্ণমালার সুরক্ষা by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগণসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক, এমনকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণদানকারীরাও বাংলা বর্ণমালার নির্ভুল পাঠ ও লেখা সম্পর্কে প্রায়ই অসচেতন। এতে করে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। বাংলা বর্ণমালার ৫০টি বর্ণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। ১১টি স্বরবর্ণ; ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ।


৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ আবার স্পর্শ বর্ণ, অন্তঃস্থ বর্ণ, শিস বর্ণ, অনুনাসিক বর্ণ প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত। এই বর্ণগুলো উচ্চারণে আমরা ভুল করি- 'স্বরে অ', 'স্বরে আ'। আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত 'বর্ণ পরিচয়' প্রথম ভাগ (প্র. প্র. ১৮৫৫)-এর ষষ্টিতম সংস্করণের (প্র. ১৮৭৫) বিজ্ঞাপনে লিখেছেন- 'প্রায়ই সর্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে বালকেরা অ, আ এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা, সেরূপ না বলিয়া, কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।' বড়ই দুঃখজনক যে উনার এই উপদেশও আমরা পালন করছি না। অ, আ-এর উচ্চারণ কখনই 'সরুয়ু', 'সরায়া' হবে না। সোজাসাপ্টা বলতে হবে 'অ' 'আ'। 'হ্রস্ব-ই' কে বলতে হবে 'ই' (ছোট করে) এবং 'দীর্ঘ-ই' কে বলতে হবে 'ই' (খানিকটা লম্বা করে)। এ ছাড়া আরো কিছু বর্ণের ভুল পাঠ শোনা যায়। যেমন- 'ঙ' কে বলা হয় উঁম (হবে 'উঁঅ'), 'ঞ' কে বলা হয় নিও, (হবে 'ইঁঅ'), 'মূর্ধন্য ণ'-কে বলা হয় 'মুর্ধিনো', 'ং' কে বলা হয় অনুস্কার (হবে 'অনুস্বার') প্রভৃতি। বর্ণমালা লেখার ক্ষেত্রেও অনেকেরই অনিচ্ছাকৃত ভুল করে থাকেন। বাংলা বর্ণমালায় মাত্রাহীন বর্ণ ১০টি অর্থাৎ এ, ঐ, ও, ঔ, ঙ, ঞ, ৎ, ং, ঃ, ঁ। অর্ধ মাত্রার বর্ণ ৯টি অর্থাৎ ঋ, খ, গ, ঝ, ণ, থ, ধ, প, শ। বাকি ৩১টি বর্ণ পূর্ণমাত্রা যুক্ত। মাত্রাহীন বর্ণে মাত্রা দিলে শব্দের বিকৃতি ঘটে। বর্ণমালা শেখানোর উপযোগী বই খুঁজতে গিয়ে আবার অনেকেই সমস্যায় পড়ে যান। বাজারের দামি দামি বইগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই থাকে বানান ভুল, বাক্য ভুল। নয়তো দেখা যায়, বইটি শিশুদের জন্য ততটা বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। ভালোমানের বই চিরদিনই ভালো। এর গুরুত্বও সুদূরপ্রসারী। খুঁজে পেতে কষ্ট হলেও এমন কিছু বই কিনে সংগ্রহ করা দরকার, যেগুলো আসলেই শিশুদের উপযোগী এবং নির্ভুল। যেমন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'বর্ণ পরিচয়', সীতানাথ বসাকের 'আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয়', রামসুন্দর বসাকের 'আদি বাল্যশিক্ষা', মদনমোহন তর্কালঙ্কারের 'শিশু শিক্ষা বই' ইত্যাদি। এগুলোর সর্বোচ্চ মূল্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা। মাল্টি মিডিয়ার মাধ্যমে আজকাল শিশুদের বর্ণমালা এবং ছড়া শেখানোর বিষয়টিও বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, বর্ণমালা ও ছড়া শেখানোর সিডি বা ডিভিডিগুলোতে মনগড়া ভুল উচ্চারণসহ আরো অনেক ভুল থাকছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার বর্ণমালার বিন্যাসই বদলে দেওয়া হয়েছে। অতি আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই যেমন- প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, পিটিআইয়ের ইন্সট্রাক্টররা প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে নিজেদের অজ্ঞতাবশত ভুল শিখিয়ে থাকেন। এতে করে চরম বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। স্বচ্ছ নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বর্ণমালাকে সুরক্ষার আর কোনো বিকল্প পথ নেই। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলা একাডেমীসহ সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতবর্গের স্বীয় উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি। ফেব্রুয়ারি মাসেই এ সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে বর্ণমালার জন্য আত্মদানের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেতে পারে বহুগুণ।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

No comments

Powered by Blogger.