ভাষাকে ব্যাপকভাবে বিকৃত করছে চলচ্চিত্র by এনামুল হক খান

জাতি হিসেবে আমরা গর্ব করি, কারণ আমাদের আছে ইতিহাস; যে ইতিহাস আমাদের পৃথিবীতে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর তা হচ্ছে ভাষার ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস। বাংলা ভাষা না থাকলে হয়তো 'মা' এমন মধুর নামে ডাকতে পারতাম না। ভাষা নিয়ে ভাবনাটা তাই চলে আসে। বাংলা ভাষা এমন একটা ভাষা, যার জন্য ঝরেছে প্রাণ।
পৃথিবীর আর কোনো দেশে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে এমন হয়নি। একুশ তাই প্রিয়জনের মতোই আমাদের স্বজন হয়েছে। রফিক, জব্বার, বরকত_তাঁদের মতো স্বজনদের হারিয়ে আমরা স্বজন পেয়েছি।
সংস্কৃতিকে যেমন অপসংস্কৃতি গ্রাস করে বাংলা ভাষাও তেমনি অপসংস্কৃতি দ্বারা আক্রান্ত। তাই সংরক্ষণ খুব বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ ভাষাটা এখন আমাদের নিজস্ব সম্পদ। আমাদের দরকার ভাষার প্রতি ভালোবাসা। বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া। সব কর্মস্থলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষার সফল প্রয়োগ ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারে। এ জায়গা থেকে বাংলা একাডেমীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শুধু পুরস্কারে ভূষিত না করে ভাষার ব্যাপারে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকাটা অনেক বেশি জরুরি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তা হচ্ছে ভাষা। এ দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলত। এখন হয়তো এটা আমাদর সম্পদ হয়েছে। আমাদের মানুষের ভাষা হয়েছে, পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, কিন্তু ভাষা হারাচ্ছে তার সুনাম, দেখা দিচ্ছে ভাষা ব্যবহারে অসঙ্গতি। সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণকে যদি বলা হয় গুরুচণ্ডালি দোষ, তাহলে বাংলা ভাষার মাঝখানে দু-একটা ইংরেজি বলা এ ধরনের মিশ্রণকে আমরা কী বলব? আজকে আমরা দেখি অনেক রেডিও চ্যানেল হয়েছে। তারা গণমাধ্যমের বাইরের কেউ নয়। আমরা লক্ষ করি, যাঁদের আমরা রেডিও জকি বলি, তাঁদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁরা বাংলা ভাষাকে তালগোল পাকিয়ে উপস্থাপন করেন। আর তাঁদের এ তালগোল পাকানো কথাগুলো অনায়াসে গিলে নিচ্ছে এ দেশের তরুণ সমাজ। আরজেদের মতো তাঁরা ভাষাকে তালগোল পাকিয়ে উপস্থাপন করছেন। গণমাধ্যম ইতিহাসের সাক্ষী। তাদের ভাষাচিন্তা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা লক্ষ করি, বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে দেখি যেমন_এইডস ও জনস্বাস্থ্য। সরকারের পক্ষ থেকে যদি ভাষা ব্যবহারের দিকটা তুলে ধরা যায়, তাহলে হয়তো ভাষাটা জেনে গ্রহণ করবে। আমাদের দেশে প্রায় ৪৫টি উপজাতি রয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে প্রায় ১২ লাখের মতো। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতাল_এদের মধ্যে অন্যতম। গারোদের ভাষার নাম গারো ভাষা, সাঁওতালদের ভাষার সাঁওতালি ভাষা। সংস্কৃতির মতো ভাষার ভিন্নতাও পরিলক্ষিত। ভাষাটা আসলে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো, যা আমাদের কাজ সহজ করে দেয়। তাদের ভাষাতেও বর্ণের ব্যবহার কম নয়, যেমন_মারমাদের বর্ণ সংখ্যা ৪৫টি; এর মধ্যে ব্যঞ্জন বর্ণ ৩৩টি ও স্বরবর্ণ ১২টি। তাদের অল্প জনগণের মাধ্যমেই তারা তাদের ভাষার ব্যবহার করে চলেছে। তাদের বাংলা ভাষাটিয় শিক্ষিত করার জন্য বাংলা পাঠ্য বইয়ের বিকল্প নেই। কোনো ভাষাই প্রভাব মুক্ত নয়। নয় আমাদের ভাষাও। নিজে ভালো থাকলে নাকি জগত ভালো, এদিক থেকে আমরা পিছিয়ে। বিদেশি ভাষার প্রভাব আমাদের ওপর পড়ে না, আমরাই পড়াই। আমাদের একটা দক্ষ জনশক্তি বিদেশি কর্মরত। তারা বিভিন্ন দেশে থাকাকালীন বিভিন্ন ভাষা আয়ত্ত করে ফলে দেশে এসে ভাষার বিকৃত ঘটায়। আমাদের দেশে প্রায় ৪৬টি ভাষা রয়েছে। বিদেশি ভাষার মধ্যে ইংরেজি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি ও হিন্দি ভাষাগুলো বেশ পরিচিত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও বাংলা বিষয়টি পাঠ্য পুস্তকে গৃহীত করলে অন্য ভাষাভাষীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাটা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করতে পারে। আমার বাণী হলো 'হিথনোলগের' মতে, বাংলা ভাষার অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে। ১৯৯৮ সালে বাংলা ভাষার অবস্থান ছিল অষ্টম, যা ২০০৯ সালে দাঁড়িয়েছে ষষ্ঠ অবস্থানে।
চলচ্চিত্র বিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম, যেখানে আমরা দেখি বাংলা চলচ্ছিত্রে ভাষাকে ব্যাপকভাবে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়, যা আমাদের কারোর কাম্য নয়। এদিক থেকে চলচ্ছিত্র প্রযোজক ও পরিচারকদের সচেতন হওয়া উচিত।
ভাষাটা আমাদের অর্জন। সংরক্ষণও করতে হবে আমাদের। তাই সবার ভাষাচিন্তা খুব বেশি প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.