বাংলায় নাম by জাহীদ রেজা নূর

আশির দশকের শুরুতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মঞ্চে শিশু-কিশোর নাট্যোৎসব হয়েছিল। ঘুম নেই নাটকটি ছিল নাজমা জেসমিন চৌধুরীর লেখা। সেই নাটকের কুশীলবদের মধ্যে দেখলাম একটি নাম—দ্যুতি অরণি। নামটা চমকে দিয়েছিল। কিশোর বয়সের সেই চমক আজও কাটিয়ে ওঠা যায়নি।


মানুষের নাম এত চমৎকার হয়! এরপর কানে আসতে থাকে অর্ণব নীলিম, ব্রতী সেঁজুতি, প্রজ্ঞা পারমিতা, নবীনা সুহাসিনী, মৃত্তিকা সহিতা, প্রত্যয় নিনাদ ও কৃতী প্রকৃতি...আরও কত নাম।
অনেকেই বলেন, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিতে আত্মস্থ হওয়ার অনুপ্রেরণা। এরই পথ ধরে এগিয়েছে সময়, চিহ্ন রেখে গেছে নিজের শরীরে। দ্যুতি অরণি সে রকমই একটি চিহ্নবিশেষ।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই বাংলা নাম রাখার চল এসেছে এই বঙ্গে। কখনো পোশাকি নামটা ভিন-ভাষায়, ডাকনাম বাংলা। কখনো প্রথম নাম বাংলা, পরে যুক্ত হচ্ছে মা-বাবার নাম; কখনো পুরো নামটাই বাংলা। মাহির হাসান সপ্তক। সবাই তাকে সপ্তক বলেই ডাকে। প্রিয়তি সায়েদা আউয়ালে আছে নিজের নামের সঙ্গে মা-বাবার নাম। আর পুরো বাংলা নামের উদাহরণ তো শুরুতেই দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের তিন মেয়ের নাম—অর্ণ কমলিকা, অর্চি মধুরিমা, প্রকৃতি শ্যামলিমা। বাংলা নাম রাখার মূল ভূমিকা স্ত্রী শাহানা রহমানের, যাঁর ডাকনাম পাপড়ি। প্রতিটি নামেরই একটি অংশ রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য থেকে নেওয়া। বাংলা নামের প্রচলন নিয়ে আতিউর রহমান বললেন, বাঙালি পরিচয়ের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব ফেলেছে। স্বতন্ত্র জাতিসত্তা, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনাও এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। স্কুল-কলেজে পড়ানোর সময় যদি দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি বিষয়ে কয়েকটি ক্লাস নেওয়া হয়, তাহলে নিজ জাতিসত্তা ও পরিচয় সম্পর্কে শিশুরা একটা ধারণা পাবে। তারাই তো বড় হয়ে মা-বাবা হবে। তখন নাম রাখার ব্যাপারে তারা বাংলাকেই অগ্রাধিকার দেবে।
প্রসঙ্গটি তুলতেই সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব আবুল মোমেন ফিরে গেলেন ষাটের দশকে। বললেন, ‘যখন থেকে ব্যাপকভাবে বাংলা নববর্ষ ও একুশে পালন করা শুরু হলো, তখন থেকেই সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঋদ্ধ হলো বাঙালি। খদ্দরের পোশাক পরা, বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা ইত্যাদি শুরু হলো। তখনই নামের ধরনেও কিছু পরিবর্তন এল। যেমন—আগে যদি কারও নাম থাকে রফিকুল হক বা রফিকুল ইসলাম, তিনি নাম পরিবর্তন করে রফিক আজাদ কিংবা রফিক মুনীর রাখা শুরু করলেন। তেমনি আসাদুল ইসলাম চৌধুরী হয়ে যেতে পারেন আসাদ চৌধুরী। এরপর একটা সময় এল, যখন বাংলা নামও যুক্ত হলো। যেমন—সুব্রত রফিক। সত্তরের দশকের শেষে পেট্রোডলারের জয়জয়কারের সময়টায় বাংলা নামের জায়গায় ভিন ভাষার নামগুলো আবার ফিরে এল। তবে এখন আবার বাংলা নামের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এখানে আমি বলতে চাই, বাংলা নাম রাখার ক্ষেত্রেও কখনো কখনো কোনো নিয়ম মানা হয়নি। নামের ক্ষেত্রে একটা ধারাবাহিকতা থাকলে ভালো, যা থেকে মানুষ ধারণা নিতে পারে—লোকটি কোন বংশের বা কোন এলাকার। একটা নিয়মানুবর্তিতা বা সূত্র থাকলে নামগুলো আরও সুন্দর হয়।’
আবৃত্তি ও অভিনয়শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ও একমত হলেন আবুল মোমেনের সঙ্গে। বললেন, ‘একসময় ফারসি ছিল রাজভাষা, তাই অনেকেরই ফারসি নাম ছিল—এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তবে ষাটের দশকে ফারসি নামের সঙ্গে বাংলাও যুক্ত হয়েছিল। এখন বাংলা নামও আসছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে—এটাও স্বাভাবিক ব্যাপার।’
এ কথা কে না জানে, ভাষাই সভ্যতা আর সংস্কৃতির ভিত্তি। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষার জুড়ি নেই। নিজ ভাষার প্রতি আবেগ-ভালোবাসার প্রকাশ আমরা দেখি সর্বত্রই। আমরাও নিজের ভাষায় নিজেদের নাম রাখব—সেটাই তো সংগত, স্বাভাবিক।

No comments

Powered by Blogger.