ফয়েজ আহ্মদের লেখা থেকে

আমরা বারোজন ও একটি ডায়েরি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক দিক থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়। বাংলাদেশ থেকে আশ্রয় গ্রহণকারীদের কাছে কলকাতা ছিল মুজিবনগর; অর্থাৎ বাংলাদেশ অঞ্চলে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী নবঘোষিত মুজিবনগর পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে কলকাতায় রাতারাতি স্থানান্তর করা হয়েছিল।


সেই থেকে বাংলাদেশ নাগরিকদের কাছে স্বাধীন সরকারের অবস্থান কলকাতাই চিহ্নিত ছিল মুজিবনগর নামে। এই রাজধানীতেই সে সময় রাজনৈতিক তৎপরতা দেশি-বিদেশি 'দূত'দের ব্যস্ততায় এমনই ঘোলাটে হয়ে উঠছিল যে, উচ্চপর্যায়ে অধিষ্ঠিত কোনো কোনো ব্যক্তি পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পথ বন্ধ করে 'রাজনৈতিক মীমাংসার' কথা চিন্তা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তান সরকারের সম্মতিতে, গোপনে উত্থাপিত এই 'রাজনৈতিক মীমাংসার' প্রস্তাব ক্রমান্বয়েই সরকার সমর্থক বৃহত্তম দলটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো ব্যক্তির সমর্থন পেতে চলছিল। মুজিবনগরে অবস্থানরত কতিপয় নীতিনির্ধারক নেতা ও ব্যক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধরত সেনাবাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও বিভিন্ন ইউনিটের গেরিলা দলগুলোর মানসিক অবস্থা এবং প্রস্তুতির সঠিক কোনো পরিচয় ছিল না। অপরদিকে আগস্ট মাসের ৮ তারিখ ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দ্রুত রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হতে থাকে এবং তারই প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি যে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি যে পরিবর্তিত হবে, সে কথার গুরুত্ব অনেকে উপলব্ধি করেছিলেন, অনেকে করেননি।
পাকিস্তানের দু'অংশে রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনের ভিত্তিতে রচিত এই রাজনৈতিক মীমাংসার ভিত্তিতে যারা গোপনে তৎপরতা শুরু করেছিলেন, তারা রক্তস্রোতে প্লাবিত বাংলার বিভীষিকাময় চিত্রটি যেন ভুলে যেতে চেয়েছিলেন। কেউ কেউ এমন মতামত ব্যক্ত করতে শুরু করেন যে, আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সম্ভব নয় এবং সে কারণে ভারতের সশস্ত্র হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয়। অপর পন্থা প্রস্তাবিত রাজনৈতিক মীমাংসা, মুক্তিযুদ্ধ নয়। এই উভয় চিন্তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের রক্তে রঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধকে পরিহার করা, যার পরিণতিতে পুনরায় পাকিস্তানের আধিপত্য পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এ ক্ষেত্রে হয়তো মীমাংসার সমর্থক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ স্থানে অবস্থানরত এই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিরা কল্পনা করতে সমর্থ হননি যে, বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারাই এই অসম্মানজনক প্রস্তাব বা কোনো প্রকার সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করতেনই অথবা অস্ত্র পরিহার করতেন না। নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী মুক্তিযোদ্ধাদের ভবিষ্যতের কথাও তারা ভুলে গিয়েছিলেন।
তারা হয়তো সেই ভয়াবহ পীড়ন, হত্যা আর ধ্বংসের কাহিনী মনে রাখতে চাননি। ২৫ মার্চের রাত ১০টার পর থেকে এম-চবি্বশ ট্যাঙ্কের গর্জন, মেশিনগান, মর্টার, বাজুকার মৃত্যুবাহী শব্দ, সাঁজোয়া গাড়ির রণহুঙ্কার সবই হয়তো তারা ভুলতে চেয়েছিলেন নিরাপদ জীবনের জন্য। পিলখানায় ইপিআর নিবাসে যে দু'দিনব্যাপী যুদ্ধ, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে ২৫ মার্চের সারা রাত যে সশস্ত্র সংগ্রাম, সাতদিন পূর্বে জয়দেবপুরে বাঙালি সেনানীর যে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ যুদ্ধ, এসবই দেশবাসীকে জীবন-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে অগি্নশিখার মতো প্রজ্বলিত করে রেখেছিল। ঢাকার রাজপথে অন্ধকার রাতে ব্যারিকেড, রেললাইনের পাশে দোকানদার ও বস্তিবাসীদের ঘুমন্ত অবস্থায় অগি্নদগ্ধ করে হত্যা, অগি্ননিক্ষেপক দিয়ে সম্পূর্ণ নয়াবাজার এলাকা ধ্বংস, ট্রাকে বন্দি চোখ-বন্ধ যুবকদের বধ্যভূমিতে প্রেরণ থেকে শুরু করে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হত্যাযজ্ঞ ও আবাসিক এলাকায় গোলাবর্ষণ পর্যন্ত বিভীষিকাময় কাহিনী কারো ভুলে যাওয়ার কথা ছিল না। তবুও অনেকে পলায়নের পথ ভেবেছেন এই আপন অতীত থেকে।প্রায় আট কোটি মানুষের রক্ত আর অশ্রুর ইতিহাস। হাজার অশ্রুসিক্ত ঘটনার উল্লেখ করেও যার ইতিহাস আংশিক করে তোলা যায় না। সামান্য ক'জন বিশ্বাসঘাতককে বাদ দিলে দেশের প্রতিটি মানুষই যেন কোনো না কোনোভাবে নিজেকে মুক্তির মন্ত্রে জড়িয়ে ফেলেছিল। সে কারণেই গণহত্যা_ সমগ্র গণমানুষই রুখে দাঁড়িয়েছিল বলে।
[অংশ : 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' গ্রন্থ থেকে]

No comments

Powered by Blogger.