ভাষার সঠিক ব্যবহারে উদাসীন টিভি-বেতার by মোশাররফ রুবেল

"আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?" চিরচেনা এই গানের কথার মতোই সত্য আমাদের একুশজুড়ে সমস্ত ভাবনা। আমি কি ভুলিতে পারি? বায়ান্নতে যে চেতনা বুকে ধরে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে রক্ত দিয়েছিলেন শহীদ সালাম, বরকত,
রফিক সেই চেতনা সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের সমস্ত চিন্তায়। ১৯৫২ সালের 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' আন্দোলন যেমন আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা এনে দিয়েছিল, তেমনি সেই ঘটনা ভুলে যাওয়া আমাদের কোনো প্রজন্মের জন্য সুখকর হবে না। দেশ, মাতৃকা, মাতৃভাষার জন্য আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার যে স্বাক্ষর আমাদের পূর্বপুরুষরা রেখে গেছেন, যুগ যুগ ধরে তা দেশপ্রেম জুগিয়ে যাবে আমাদের চেতনায়, ভাবনায়।
ভাষা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করতে প্রথমত, আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটা উপলব্ধি করা যে, ভাষা সংরক্ষণ করা কতটা জরুরি! ৫২'-এ অনেক রক্ত ও সংগ্রামের বিনিময় হিসেবে পাওয়া আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা। তাই বাংলা ভাষা সংরক্ষণ একান্ত জরুরি। একটি ভাষা সংরক্ষণের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হতে পারে বই পুস্তকের মাধ্যমে সংরক্ষণ। সঠিক ভাষার ব্যবহারে ভালো মানের বই লেখার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে সেটা পেঁৗছে দেওয়া হতে পারে বাংলা ভাষা সংরক্ষণের একটি মাধ্যম।
বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগ, চর্চা ও সাহিত্য রচনায় এর বাস্তবসম্মত সমৃদ্ধি সম্ভব। ভাষা বিকৃত না করে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধসহ মানসম্মত সাহিত্যচর্চা করে এর যথাযথ সমৃদ্ধি সম্ভব।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ভাষা ব্যবহারে অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। আমাদের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্ম সবার শেখার অনেকটা মাধ্যম যুক্ত থাকে টিভি, রেডিওসহ নানা মাধ্যমের সঙ্গে। এতে তাদের মন-মানসিকতা অনেকটাই প্রভাবিত হয়ে থাকে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভাষা প্রয়োগের মাঝে বাংলা ভাষার সঙ্গে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার ব্যাপক মিশ্রণ দেখা যায়, যা অসংগতিপূর্ণ এবং বাংলা ভাষার জন্য ক্ষতিকরও বটে। কতিপয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক/উপস্থাপিকা ও এফএম রেডিওগুলোর রেডিও জকি এ ব্যাপারে বেশ উদাসীন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম টিভি দেখা, রেডিও শোনার মাধ্যমেই বেড়ে ওঠে। তাদের মাঝে বিরাজ করে এসব কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার। তাই এ ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট যত্নশীল হওয়া উচিত।
দেশের সরকারপ্রধানের ভাষার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত ও ভূমিকা অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়ে ভাষা সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে। আর গণমাধ্যম এর মাধ্যমে ওই ভাষাভাষী সমগ্র মানুষ জানতে পারে এবং পেতে পারে সঠিক দিক-নির্দেশনা। তা ছাড়া ভাষা ব্যবহারে যেকোনো অসংগতি ও অপব্যবহারে সরকার নিতে পারে সঠিক পদক্ষেপ। যেকোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত অনেক বেশি মূল্যায়িত করতে পারে গণমাধ্যমগুলো। কারণ, তাদের সঙ্গে ওই ভাষার সব মানুষের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। তা ছাড়া যেকোনো সৃজনশীল কাজে সহায়তা ও এর বিকাশ ঘটাতে পারে গণমাধ্যমের সদিচ্ছা।
ক্ষুদ্র ভাষাভাষীর যে মানুষগুলো আছে তাদের ভাষা সংরক্ষণে প্রথমত তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। নিতে হবে পদক্ষেপ। তা ছাড়া ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চায় সরকার ও ভাষাবিদদের এগিয়ে আসা একান্ত জরুরি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিভিন্ন কারণে দেশে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সংস্কৃতি প্রবেশ করে থাকে। এই সংস্কৃতির সঙ্গে প্রবেশ করে বিভিন্ন রকমের ভাষা আচার-আচরণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নানা রকম শব্দ ও আচরণে বাংলা ভাষাকে প্রভাবিত করে যায় এসব। ভাষার সুষ্ঠু ব্যবহার ও প্রয়োগের বদলে বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ শব্দের মিশ্রণে প্রভাবিত হয় আমাদের অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা, যা আমাদের জন্য কখনোই কাম্য নয়। জাতি হিসেবে আমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। ইন্টারনেট ও বহিরাগত গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কিছু কিছু ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের নতুন প্রজন্মসহ বাংলা ভাষার ওপর পড়ছে। ভাষাবিশ্লেষক ও ভাষাবিদের যথাযথ পরিকল্পিত পদক্ষেপ এ প্রভাব থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করতে পারে। আমরা সবাই জানি, জাতিসংঘ 'বাংলা ভাষা'কে আন্তর্জাতিক মাতৃষার স্বীকৃতি দান করেছে। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হলেও যথাযথভাবে তার পালন হয় না। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.