দূতাবাসে নিরাপত্তা by এবনে গোলাম সামাদ


১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বিভিন্ন দেশে বিবেচিত হয় তারা যেসব দেশের দূতাবাস তার এলাকা হিসেবে। প্রত্যেকটি দূতাবাসের চৌহদ্দির মধ্যে চলে যে দেশের দূতাবাস তারই আইন, যে দেশে ওই দূতাবাস অবস্থিত সে দেশের কোনো আইন নয়।
যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Status of extra territoriality. এটা এখন সর্বসম্মত প্রথা। আমরা এখন এসব কথা জানি। আমরা এও জানি, প্রত্যেকটি দূতাবাস তার নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত করতে পারে তার নিজের দেশ থেকে আনীত নিজস্ব প্রহরীদের। ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস (হাইকমিশন) তার নিরাপত্তার জন্য ভারত থেকে এনেছে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভারতীয় বাহিনীকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই বাহিনী ভারতীয় দূতাবাসের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে পাহারা দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটাকে বেআইনি বলা যাবে না। কারণ ভারতীয় দূতাবাস ভারতীয় এলাকা, বাংলাদেশের এলাকা সেটা নয়। কিন্তু এই প্রহরীরা প্রহরী হিসেবে কখনোই দূতাবাসের বাইরে আসতে পারবে না। যদি তারা আসে, তবে সেটা হবে সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। সেটা গণ্য হবে বাংলাদেশের সার্বভৌম ও স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে। পত্র-পত্রিকার এবং টেলিভিশনের খবরে প্রকাশ, ভারতীয় হাইকমিশনের প্রহরীরা হাইকমিশনের সীমানার বাইরে এসে করেছে এদেশের নাগরিকদের পথরোধ। করেছে তাদের বহুবিধ প্রশ্ন। যেটা করার কোন অধিকার আন্তর্জাতিক আইন তাদের প্রদান করেনি। এখানে উঠছে ভারতের আচরণ নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন।

ঢাকায় অন্য আরও অনেক দূতাবাসের আছে নিজস্ব প্রহরী। কিন্তু তারা এভাবে বাইরে এসে এদেশের নাগরিকদের কখনও আটকিয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। তারা মেনে চলেছে ভিয়েনা কনভেনশন। ভারতের পত্র-পত্রিকা বলছে, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন নাকি লস্কর-ই-তৈয়বা নামক একটি উগ্র মুসলিম জঙ্গিবাদী প্রতিষ্ঠান দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু এই লস্কর-ই-তৈয়বা একটি রহস্যময় দল। পাকিস্তানের কিছু পত্র-পত্রিকার সাম্প্রতিক অভিমত হলো, দলটি নাকি ভারতেই তৈরি। দলটিকে তৈরি করা হয়েছে নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। একথা কতদূর সত্য, আমরা তা বলতে পারি না।
তবে এদেশে লস্কর-ই-তৈয়বা নামে যে ক’জন ধরা পড়েছে, তারা সবাই ভারতীয় নাগরিক। ভারত থেকেই তারা এসেছে বাংলাদেশে। আমরা যতদূর জানি, মুসলিম মৌলবাদের সংঘাত বেধেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে; ভারতের সঙ্গে নয়। কেন তারা বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসকে আক্রমণ করবে সেটা তাই আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ভারত আসলে কী চাচ্ছে আমরা সেটা জানি না। তবে হয়তো বাংলাদেশে নানা অঘটন ঘটিয়ে সে প্রমাণ করতে চাইতে পারে যে, বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে একটা উগ্র ইসলামের ঘাঁটি। সেটাকে প্রতিরোধ করার জন্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হবে ভারতের সেনা ছাউনি। বাংলাদেশ মুসলিম মৌলবাদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে, এরকম অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও তোলেনি। কিন্তু ভারতের পত্র-পত্রিকা তুলছে। আর তাতে আসছে লস্কর-ই-তৈয়বার নাম।
পাকিস্তানে জঙ্গি ইসলাম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু ভারত সেখানে তার দূতাবাস রক্ষার জন্য বাংলাদেশের মতো প্রহরী ব্যবহার করতে এখনও সক্ষম হয়নি। ইসলামাবাদে হাইকমিশনে ভারতীয় প্রহরীরা সেখানে থাকছে ভারতীয় হাইকমিশনেরই চৌহদ্দির মধ্যে। তারা আসছে না তার বাইরে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটতে দেখা যাচ্ছে এর ব্যতিক্রম।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে যেমন আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ আনার কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ভারতীয় দূতাবাস আসলে ঢাকায় হয়ে উঠতে চাচ্ছে একটা ভারতীয় দুর্গ অথবা সেনা ঘাঁটি। বাংলাদেশের মানুষ তাই তাদের সরকারের কাছে পেতে চাচ্ছে ভারতীয় কার্যকলাপের ব্যাখ্যা। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে যা বলা হচ্ছে তা সৃষ্টি করছে বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ সরকারিভাবে এদেশের সব বিদেশি দূতাবাসকে নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষমতা রাখে। ব্রিটিশ দূতাবাসের (হাইকমিশন) সাবেক হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী সিলেটে যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কিছু না জানিয়েই। ফলে তার ওপর সেখানে হতে পারে হামলা। এ হামলার প্রকৃত কারণ কী ছিল আমরা তা জানি না। তবে এটা হতে পেরেছিল আনোয়ার চৌধুরীর রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রটোকল না মানারই কারণে। আর কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত যদি কূটনৈতিক বিধিনিষেধ অবজ্ঞা করে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় যেতে চান, তবে তার ওপর হতে পারে হামলা। কিন্তু তার জন্য কোনোভাবেই বাংলাদেশকে সেক্ষেত্রে দায়ী করা যাবে না। সব দেশের রাষ্ট্রদূতকেই বাংলাদেশে এসে মেনে চলতে হবে সাধারণভাবে স্বীকৃত কূটনৈতিক বিধিবিধান। এমন কিছু করা চলবে না, যা বিবেচিত হতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে বাংলাদেশ কোনো বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখেছে বলে আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশ তার ভারতের হাইকমিশনে নিরাপত্তার জন্য আস্থা রাখতে পারছে ভারত সরকারের ওপর।
অথচ ভারত সরকার অনুরূপ আস্থা রাখতে পারছে না বাংলাদেশ সরকারের ওপর। এটা আসলে হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর। দল হিসেবে বিএনপি ভারতীয় নীতির সমালোচনা করেছে। বিএনপিকে আওয়ামী লীগ অভিযুক্ত করছে উস্কানিমূলক প্রচারণার জন্য। যেখানে দেশের সাধারণ স্বার্থ জড়িত, সেখানে আসা উচিত একটা ঐকমত্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটা চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন ভারত তার দূতাবাসের নিরাপত্তার প্রশ্নটি ওঠায়নি। কিন্তু এখন ওঠাচ্ছে। ভারতের গোয়েন্দা চক্রের লোকেরা করছে আমাদের সড়ক অবরোধ। এসব খবর যেসব পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি, তারা অনেকেই বিএনপি ঘরানার নয়। তাই বিষয়টিকে কেবল বিএনপির অপপ্রচার বলে গ্রহণ করা ঠিক হবে না। ভারত কিছুদিন আগে উলফাদের সম্পর্কে গ্রহণ করেছে কঠোর নীতি। আসাম বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া। উলফারা সেখান থেকে এসে ঢাকাস্থ হাইকমিশনকে আক্রমণ করতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা খুব বেশি বলে মনে করা যায় না। আর ভারত সরকারও বলছে না এরকম হামলার সম্ভাবনার কথা। তারা কেবলই প্রচার করছে জঙ্গি ইসলামের ভীতি। যেটাকে মনে হচ্ছে বিশেষ দুরভিসন্ধিমূলক। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ভোগ করেন কূটনৈতিক অনাক্রমণতা (Diplomatic immunity) । তার সঙ্গে জড়িত কর্মচারীরাও ভোগ করেন কূটনৈতিক অনাক্রমণতা। কিন্তু দূতাবাসে সবাই যারা কাজ করে, তারা কূটনৈতিক অনাক্রমণতা ভোগ করে না। স্থানীয় অনেক লোক কাজ করে দূতাবাসে। যাদের মাধ্যমে দূতাবাসগুলো সংগ্রহ করে অনেক গোপন সংবাদ, যা রাষ্ট্রদূত পাঠান তার নিজের দেশে। এসব সংবাদের ওপর নির্ভর করে একটি দেশ নির্ধারণ করে আরেকটি দেশ সম্পর্কে তার পররাষ্ট্রনীতি। দূতাবাসগুলো একদিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় গোয়েন্দা চক্রের ঘাঁটি। তবে এই গোয়েন্দাবৃত্তি পেতে পেরেছে সাধারণ স্বীকৃতি। খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে একটি দেশ আর একটি দেশের বিরুদ্ধে এক্ষেত্রে প্রতিবাদ করে। আমাদের খুব গোপন খবর বিশেষ কিছু নেই। তবু গোপন খবর যাতে বাইরে বেরুতে না পারে সে বিষয়ে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। সেটা ১৯৬৩ সালের কথা। পাকিস্তান আমলে রাজশাহী হয়ে উঠেছিল একটা ভারতীয় গোয়েন্দা চক্রের (Espionage) ঘাঁটি। রাজশাহীতে অবস্থিত ভারতের অ্যাসিসটেম্লট হাইকমিশনে কাজ করতেন ১৫০ জনের ওপর কর্মচারী। এত কর্মচারী অ্যাসিসটেম্লট হাইকমিশনে কাজ করা ছিল খুবই সন্দেহজনক ঘটনা। পাকিস্তান সরকার তাই সে সময়ে রাজশাহী থেকে অ্যাসিসটেম্লট হাইকমিশন অফিস তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সাবেক পাকিস্তান আর নেই। সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান আজ পরিণত হয়েছে একটা পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশে।
কিন্তু আজ আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। আর থাকছে তাই ভারত নিয়ে বিশেষভাবে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান আর ইতিহাসের ধারা এমন যে, এখন তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে প্রধানত ভারতেরই কারণে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত হবে না, ভূগোল ও ইতিহাসের বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে রাজনীতি করা।
আমাদের বাড়ির কাছে নেপালে ভারত বিশেষ বাহিনী পাঠিয়ে পড়েছে বিপাকে। কেবল নেপালের মাওবাদীরাই নয়, সাধারণভাবে নেপালিরা এজন্য ভারতের ওপর হয়ে উঠেছে ক্ষুব্ধ। তারা চাচ্ছে না নেপালের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যদি চায় উন্নত সম্পর্ক গড়তে, তবে কূটনৈতিক কূটকৌশল বা চাণক্যনীতি পরিত্যাগ করে গ্রহণ করতে হবে সমান অধিকারের ভিত্তিতে খোলামেলা সহজ পন্থা। আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় থাকলেও তারাই যে এদেশের জনমতের প্রতিভূ, তা ভাবলে ভুল করা হবে। ভারতকে শ্রদ্ধা করতে হবে এদেশের সাধারণ জনমতকে।

No comments

Powered by Blogger.