এপ্রিল ১৯৫৫-বর্ধমান ভবন by সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ

মোগল রাজধানী ঢাকার বয়স ৪০০ বছরের বেশি; শহর ঢাকার বয়স তার চেয়ে আরও কয়েক শ বছর বেশি হবে। ঢাকায় মোগল যুগের চিহ্নের মধ্যে লালবাগ দুর্গ আর কয়েকটি মসজিদ ছাড়া তেমন কিছু টিকে নেই। ঢাকার নবাবদের কিছু ঘর-বাড়ি-মাজার আছে মূলত পুরান ঢাকায়; আর আছে বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে মূলত বেশ কিছু দোতলা-তিনতলা বাড়ি।


এর বেশ কিছু বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপকরণ।
রমনার বাড়িগুলো মূলত বিশ শতকের শুরুর দিকে বঙ্গভঙ্গের সময়ে ঢাকাকে পূর্ববঙ্গ-আসামের রাজধানী করার জন্য তৈরি। সচিবালয়ের জন্য বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভবন, ছোট লাট থাকার জন্য পুরোনো হাইকোর্ট ভবন, অনেকটা সিটি হল হিসেবে কার্জন হল, উচ্চপদস্থ সরকারি ব্যক্তিদের জন্য বেইলি রোড, মিন্টো রোডের লাল রঙের একতলা বা দোতলা বাড়ি—সবই এ সময়ে করা। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে মনে করা যায় যে বর্ধমান হাউসের দোতলা ভবনটিও এই সময়ে তৈরি হয়েছিল।
‘বর্ধমান হাউস’ নামটি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি রয়েছে। নামকরণ থেকে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে বর্ধমানের মহারাজার ভবন ছিল এটি। কিন্তু বর্ধমানের মহারাজা এই ভবন নির্মাণ করেছেন, এমন কোনো তথ্য এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা পূর্ববঙ্গ-আসামের রাজধানী থাকাকালে (১৯০৫-১২) বর্ধমান ভবন নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাজে ব্যবহূত হতো।
বঙ্গভঙ্গ রদের প্রায় ১০ বছর পর বাংলা অঞ্চলে ‘ডায়ার্কি’ বা দ্বৈত শাসন চালু হয়; দ্বৈত শাসনে দ্বিতীয় রাজধানী ছিল ঢাকা। ১৯২১ থেকে ৩৭ পর্যন্ত চলা ডায়ার্কির যুগে বর্ধমানের তৎকালীন মহারাজা স্যার বিজয় চাঁদ ১৯১৯-২৪ পর্বে বাংলার গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্য ছিলেন। সে সময়ে দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকায় পরিষদ সভায় যোগদানকালে তিনি এই বাড়িতে বাস করতেন বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। সম্ভবত সেখান থেকেই এই বাড়ির নাম বর্ধমান হাউস।
রমনায় রাজধানী করার উদ্দেশ্যে নির্মিত ভবনগুলো নিয়েই ১৯২১ সালে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ও বিভিন্ন সময়ে বর্ধমান হাউসকে তাদের আবাসরূপে ব্যবহার করেছে। কাজী মোতাহার হোসেনের নানা স্মৃতি থেকে জানা যায় যে ১৯২৬ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রূপে এই বাড়িতে তিনি বেশ কিছুদিন বাস করেছিলেন। এই সময়েই কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা সফরকালে মোতাহার হোসেনের অতিথিরূপে কয়েক দিন বর্ধমান ভবনে বাস করেন। এটি সম্ভবত জুনের শেষ সপ্তাহে। কাজী মোতাহার হোসেন ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অধ্যাপক, এমনকি ছাত্ররাও অস্থায়ীভাবে বর্ধমান হাউসে ছিলেন এমন তথ্য দিয়েছেন অনেকে।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পূর্ব বাংলার প্রিমিয়ার হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দীন ব্রিটিশদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন কার্জন হলে। বর্ধমান হাউসকে পূর্ব বাংলার সরকারপ্রধানের বাসভবন করা হয়। অনেকের মতে, নাজিমুদ্দীন বর্ধমান হাউসে রাত্রিবাস করতেন না; তবে সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করতেন। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে করাচিতে চলে যান। নুরুল আমিন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তখন থেকে ১৯৫৪ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত নুরুল আমিন বর্ধমান ভবনে বাস করেছেন।
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় ছাত্ররা তৎপরতা শুরু করেন ১৯৪৭ সালের শেষ দিক থেকেই। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তা আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। এ সময়ে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে নাজিমুদ্দীনের কয়েকটি বৈঠক হয়। নানা স্মৃতিকথায় দেখা যায় যে ছাত্র প্রতিনিধিরা অন্তত একবার নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে বর্ধমান ভবনে দেখা করেছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদের রক্তে ঢাকার কালো পিচ রঞ্জিত হলে জনতার রোষ বর্ধমান হাউসের ওপরে পড়ে। কেননা, ওখানেই তখন বাস করতেন পূর্ববাংলার সরকারপ্রধান নুরুল আমীন। কেউ কেউ মনে করেন যে এই ভবন থেকেই গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায় যে সেদিন পুলিশ মোট ২৭টি গুলি করেছিল এবং এর প্রথমটি চলে বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে। সে সময়ে অ্যাসেম্বলি শুরুর আগ মুহূর্তে নুরুল আমীন কোথায় অবস্থান করছিলেন, তা জানা নেই। তবে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বর্ধমান হাউসই জনতার চোখে পড়ে।
নির্যাতনের এই প্রতীককে বাংলা ভাষা চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করার দাবি উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের বছরেই (১৯৫২)। তবে এটি আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৬ সংখ্যক দাবিতে, যাতে বলা হয় যে ‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে অপেক্ষাকৃত কম-বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।’
নুরুল আমীন বর্ধমান ভবন ত্যাগ করেন ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু ৩০ মে ৯২-ক ধারা জারি করে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়; সেবারে তারা বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত করতে পারেনি। ১৯৫৫ সালের জুনে আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতা নিলে সে বছরের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান ভবনে বাংলা একাডেমীর যাত্রা শুরু হয়। বর্ধমান ভবনের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির দীর্ঘ মিলনের এখানেই শুরু।
নুরুল আমীনের ভবন ত্যাগ ও বাংলা একাডেমী গঠনের মধ্যবর্তী সময়ে বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাহিত্য সম্মেলন ও গ্রন্থ প্রদর্শনী (এপ্রিল, ১৯৫৫); পূর্ব পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক নৃত্য সম্মেলনের (ডিসেম্বর-জানুয়ারি, ১৯৫৪-৫৫)। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান প্রায় দুই মাস বাস করেন বর্ধমান হাউসে, তখন তাঁর বয়স ৮৮। বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমী স্থাপিত হলেও পুরো দোতলা ভবনের অধিকার পেতে একাডেমীর অনেক সময় লেগেছিল। পুরো দোতলা ভবনটি একাডেমীর অধিকারে আসে ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে; তখন ড. মুহম্মদ এনামুল হক একাডেমীর পরিচালক।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে এটি ৯৯ বছরের জন্য বাংলা একাডেমী ইজারা পায়।
১৯৬০-এর দশকে বর্ধমান ভবন ও সংলগ্ন দালানে নজরুল-ইকবাল একাডেমী; পাকিস্তান রাইটার্স গিলড প্রভৃতির কার্যালয় ছিল। ১৯৬২ সালে নির্মাণ করা হয় এর তৃতীয় তলা। পরে বর্ধমান হাউসের পেছনে গড়ে উঠেছে চারতলা প্রেস ভবন, তিনতলা গুদাম, সামনে বাম কোনায় ব্যাংক ও পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্র এবং সম্প্রতি পুকুরপাড়ে আটতলা নতুন ভবন ও মিলনায়তন। কিন্তু এত কিছুর পরও বর্ধমান ভবনই বাংলা একাডেমীর প্রতীক।

No comments

Powered by Blogger.