একজন অতন্দ্র সাহসী মানুষ by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সামাজিক, সাংস্কৃতিক চেতনা উন্নয়নের যে অঙ্গীকার তাকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছিল, সে অঙ্গীকার ছিল সমাজতান্ত্রিক। এ কারণে তাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে বহুদিন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দুই দলের ঐক্য তৈরিতে এবং বিভিন্ন পেশাজীবীকে সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন ফয়েজ আহ্মদ।


এ জন্য সে সময় জেলেও যেতে হয়েছিল তাকে ফয়েজ আহ্মদের মৃত্যু, নিঃসন্দেহে একটা মর্মান্তিক ঘটনা। কিন্তু তবুও এখন এই মর্মান্তিকতার চাইতেও আমার স্মৃতিতে, তিনি যে ছিলেন সে কথাটাই বড় হয়ে আছে এবং থাকবে। এটা কেবল আমার জন্য নয়, তার সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে ছিলেন এমন সবার জন্যই সত্য।
ফয়েজ আহ্মদ নিজে অকৃতদার ছিলেন, সে অর্থে তার নিজের কোনো পরিবার ছিল না। কিন্তু তার পরিবার ছিল তার আশপাশের সবাই। পরিচিত সব মানুষই যেন ছিল তার পরিবারের অংশ। আমরা তাকে ফয়েজ ভাই বলে ডাকতাম। ফয়েজ ভাইয়ের মূল বিষয়টা হলো, তার একটা অঙ্গীকার ছিল। সাংবাদিক ছিলেন। ছড়া লিখতেন, প্রবন্ধ লিখতেন আর সবকিছু মিলিয়ে বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন চাইতেন। এটা একটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার তার সকল কাজের মধ্যেই আমরা পাই। তিনি সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন বেশি। তার অনুসন্ধানী ও প্রত্যুৎপন্নমতিতার নিদর্শন তার সাংবাদিকতায় যেমন পাওয়া যেত, তেমনি পাওয়া যেত অন্য লেখাতেও। তবে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে তার একটি বড় পার্থক্য ছিল_ তিনি সহকর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতা করতেন, শেখাতেন। আমার মনে আছে, একবার বাসসের একটা রিপোর্টে বড় ধরনের ভুল হওয়ার কারণে এক রিপোর্টার তৎকালীন সরকারপক্ষের রোষানলে পড়েছিল। ফয়েজ ভাই নিদ্বর্িধায় তাৎক্ষণিকভাবে ভুলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সম্পাদক ছিলেন। 'বঙ্গবার্তা' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তারও আগে ১৯৭০ সালের শেষ দিকে 'স্বরাজ' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। স্বরাজের ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের আগের একটি সংখ্যায় 'অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত' এই মূল শিরোনামে লিখেছিলেন। ওই একই সংখ্যায় আরেকটি চাঞ্চল্যকর লেখা ছিল এই শিরোনামে_ 'কীভাবে ককটেল বানাতে হবে?'
স্বভাবতই তার ওপর আক্রমণ হতে পারে_ এ কারণে সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। ২৫ মার্চেও বাসায় না থেকে তিনি ছিলেন প্রেস ক্লাবে। সেখানে আক্রমণ হলে হুট করে সরে পড়তে পেরেছিলেন। পরে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। সেখানে থেকে নিয়মিত লিখতেন। আসলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক চেতনা উন্নয়নের যে অঙ্গীকার তাকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছিল, সে অঙ্গীকার ছিল সমাজতান্ত্রিক। এ কারণে তাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে বহুদিন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দুই দলের ঐক্য তৈরিতে এবং বিভিন্ন পেশাজীবীকে সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন ফয়েজ আহ্মদ। এ জন্য সে সময় জেলেও যেতে হয়েছিল তাকে। তিনি তার সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিকে আলাদা করে দেখতেন না। দুটোকে একই সঙ্গে পরিচালনা করতেন নিজের সেই অন্তর্গত অঙ্গীকার থেকে। পরিশ্রমীও ছিলেন প্রচণ্ড রকমের। আবার এত কিছুর পরও একটা কোমল মানসিকতা তার ছিল। যে মানসিকতায় তিনি ছড়া লিখতেন। তার লেখালেখিও শুরু হয় এই ছড়া দিয়েই।
আজ ২০ ফেব্রুয়ারি। মনে পড়ছে এক ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আমি ফয়েজ ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম প্রেস ক্লাবে। রাত বেশি হওয়ায় আমি বাসায় যেতে পারিনি। ফয়েজ ভাই আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। রাতে ঘুমাতে গিয়ে নিজের বিছানা আমাকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে শোবেন। তার এমন কথায় আমি রাজি না হওয়ায় আমাদের মধ্যে একটা জোরাজুরি লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি বসার ঘরের সোফাতে ঘুমাবেন_ এমন শর্তে রাজি হয়েছিলেন। তার চারিত্রিক এমন অসংখ্য বৈশিষ্ট্য আমাদের মুগ্ধ করত সবসময়। ফয়েজ ভাই রাজনীতি এবং সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতির ভেতরই সংস্কৃতি মিশে থাকবে। রাজনীতি সংস্কৃতিকে ত্যাগ করলে সেটা কেবল ধ্বনিনির্ভর হয়ে পড়বে, সেটা গভীর হবে না। এ চিন্তা থেকে যেভাবে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতেন, একইভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও থাকতেন ক্রিয়াশীল। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় উৎকর্ষতা এবং শিল্পকর্মকে দর্শকদের কাছে নিয়ে যেতে তিনিই প্রথম আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন। শিল্পকর্মের বীমা ব্যবস্থার প্রচলনের বিষয়টিও তিনি তৈরি করেছিলেন।
রাজনীতি-সংস্কৃতি_ মানুষের সকল ক্ষেত্রে বিচরণকারী ফয়েজ ভাই ছিলেন বিরল দৃষ্টান্ত। সবমিলিয়ে সমাজ ও প্রগতির পক্ষে তিনি ছিলেন মধ্যরাতের অশ্বারোহীর মতোই অতন্দ্র। বিদায় মধ্যরাতের অশ্বারোহী।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.