আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসী থাবায় বাংলা ভাষা by মনিরা রহমান টুম্পা

আবার এসেছে ফিরিয়া একুশে ফেব্রুয়ারি বেদনার স্মৃতিরে ঘিরিয়া করিছে অশ্রুবারি' ১. এই মহাবিশ্বের বুকে দুএকটা বিশেষ দিন নিজ মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আপন অস্তিত্ব ঘোষণা করে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারিও বাংলাদেশের জন্য এমন একটি অবিস্মরণীয় দিন। এ দিনটিতেই বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধের পুনর্জন্ম হয় মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে


প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। সমগ্র পৃথিবীতে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এমন নজির আর নেই। তাই একুশ আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ও অধিকার আদায়ের প্রেরণা এবং এগিয়ে যাওয়ার মূল শক্তি।
কিন্তু ইদানীং আমরা লক্ষ্য করছি, নানাভাবে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলার বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক নিজেদের শিক্ষিত ও উঁচু শ্রেণীর বলে প্রমাণ করার জন্য বাংলা ভাষাকে নিচু করার প্রচেষ্টায় রত রয়েছেন এবং তাঁরা দিনে দিনে দলে ভারী হচ্ছেন! এই দেখে আমাদের মনে শঙ্কা জাগে এত সাধের বাংলা ভাষা কি আদৌ অদূর ভবিষ্যতে বিকৃতির কৃত্রিমতা এড়িয়ে অকৃত্রিম থাকতে পারবে? এই প্রশ্নের রেশ ধরে তাই ভাষা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।।
২. এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের অধিকারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯৬৫ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানটি (পরবর্তী নাম বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান) যেমন আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা সংরক্ষণে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, ঠিক তেমনি করে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য আরো প্রস্ফুটিত ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলা বাচনের যে একটি আদর্শ বা প্রমিত রূপ আছে তার একটি যথাযথ রূপ প্রণয়ন, সংরক্ষণ একই সঙ্গে সর্বসাধারণের কাছে যেন তা বোধগম্য, গ্রহণযোগ্য ও সুলভে সংগ্রহযোগ্য হয়, সে বিষয়ে গভীর দৃষ্টিপাত করা এবং সেসঙ্গে যারা ভাষাকে বিকৃত করতে উদ্যত তারাসহ সর্বস্তরের সবার মাঝে সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ভাষা-সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর এখানেই আমাদের মূল সমস্যা নিহিত। কেননা এক নদী রক্তের বিনিময়ে বাংলা আজ রাষ্ট্রভাষা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেলেও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষার হার আগের তুলনায় বাড়লেও তা সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।
৩. ফলে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়। আজকাল তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসী প্রভাবে। এ সময়ের ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরা হিন্দি ভাষায় ডাবিংকৃত কার্টুন দেখে দেখে হিন্দিতে কথা বলছে, এমনকি বিভিন্ন হিন্দি চ্যানেলের সহজপ্রাপ্যতার ফলে এর প্রভাব বড়দের ওপরও বিস্তার লাভ করছে।
৪. তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষাকে এসব রাহুর গ্রাস থেকে রক্ষা করতে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে হিন্দি চ্যানেলগুলোর এ দেশে অবাধে প্রদর্শনের হিড়িক শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে। বর্তমান নীতিমালার প্রয়োজনীয় সংস্কার ও কার্যকর নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে যথাযথভাবে প্রয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে। নিজ দেশের দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় এবং এর প্রচার ও প্রসারে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকতে হবে। এ ছাড়া গণমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে অত্যন্ত কার্যকর, সুদূরপ্রসারী ও বিস্তর ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা, গণমাধ্যমগুলো এ দেশের গণমানুষের অনেক কাছাকাছি, আর তাই গণমাধ্যমের প্রভাব খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে বিশেষ করে ইদানীংকার কিছু নাটকে হিন্দি ও ইংরেজি শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং হিন্দি সিরিয়ালের আদলে নাটক নির্মাণ আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে! যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। এ ব্যাপারে আমরা সচেতন তরুণেরা প্রতিবাদ জানাই এবং এ ধরনের নিছক অনুকরণের প্রতি আমাদের নিন্দা জ্ঞাপন করছি। আর এই মর্মে গণমাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো সংশোধনের নিমিত্তে করণীয় কর্তব্য পালনের আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ গণমাধ্যমগুলো একত্রে মিলে একটি সক্রিয় মাধ্যম, যার মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত ও যুগের অস্থিরতায় কাতর জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করে জাতির বৃহত্তর উন্নয়নে নিয়োজিত করা সম্ভব।
৫. জাতির এই সামগ্রিক উন্নয়নের স্রোতধারাকে আরো বেগবান করতে আমাদের যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে, তাদেরও আমাদের সঙ্গে নিতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা। তাই এসব জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব যে ভাষাগুলো আছে, সেগুলো সংরক্ষণেও আমাদের মনযোগ ও গুরুত্ব দিতে হবে।
৬. এবার আসা যাক বাংলা ভাষার ওপর বিদেশি ভাষার প্রভাব-সম্পর্কিত কিছু কথায়। বেশ কিছুদিন আগ থেকে লক্ষ করলে বোঝা যায়, আমরা বাঙালিরা আর শুধু বাংলায় কথা বলি না। বলি হিংলা (বাংলা+হিন্দি), বাংলিশ (বাংলা+ইংরেজি) কিংবা হিংরেলা (বাংলা+হিন্দি+ইংরেজি) ভাষায়, যা কিনা পরিবেশের ভাষায় অত্যন্ত দূষিত। আমরা একেকজন আবার এটাকে একেকভাবে গ্রহণ করি। কেউবা আভিজাত্য প্রকাশে, যেমন_শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিতরা; কেউবা স্মার্টনেস হিসেবে, যেমন_কিশোর ও তরুণ বয়সের যারা; কেউবা আধুনিকতা হিসেবে, যেমন_যারা কিছুই বোঝে না। যাই হোক, আমরা যারা এভাবে না জেনে বা না বুঝে বাংলা ভাষার ওপর অন্য ভাষার আধিপত্য বিস্তারে কাজ করে চলেছি তাদের উপলব্ধির বন্ধ চোখের পাতা খুলে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা। কেন না, আর যাই হোক এতো রক্তের বিনিময়ে যে ভাষার জন্ম ও উন্মেষ, সে ভাষার ওপর আর অন্য কোনো ভাষার আধিপত্যকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এবার, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পৌঁছে দিতে হলে প্রয়োজন জাতির আত্ম-উন্নতি। অর্থাৎ আমাদের সব দল, মত, পথ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে হবে। স্বনির্ভর হতে হবে। তাহলেই আমরা জাতি হিসেবে যখন আন্তর্জাতিক দরবারে গ্রহণযোগ্যতা ও স্বীকৃতি পাব, তখনই আমাদের ভাষাও মর্যাদার আসনে আসীন হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও প্রকৃত আন্তর্জাতিকীকরণ তখনই সম্ভবপর হবে, যখন দেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে একাত্মতা, দেশাত্ববোধ, ভাষা ও সংস্কৃতিবোধ জাগ্রত হবে।

No comments

Powered by Blogger.