অনন্য এক প্রতিভা by এম শামসুর রহমান

উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী নওগাঁ কে ডি উচ্চ বিদ্যালয়ে (স্থাপিত ১৮৮৪) প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত একটানা দশ বছর অধ্যয়ন করেছি। শশধর কুণ্ডু নামে এই বিদ্যালয়ে একজন প্রবীণ সহ-প্রধান শিক্ষক ছিলেন সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ আগের গণিতে এমএসসি।
সপ্তম থেকে দশক শ্রেণী পর্যন্ত কুণ্ডু স্যার আমাদের গণিত পড়াতেন। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম ছিল।
তার কাছে শুনেছি কুড়ির দশকের প্রথমভাগের একটি অভিজ্ঞতার কথা। স্কুল বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে পরীক্ষা হলে তিনি গেলেন পরীক্ষা শুরুর দেড়-দুই ঘণ্টার মাথায়। একদিন পরীক্ষা হলে দেখলেন সিটে তার প্রিয় ছাত্র 'হুমায়ূন' নেই। 'কী ব্যাপার, হুমায়ূন আজ পরীক্ষা দিতে আসেনি'_ কুণ্ডু স্যারের এই বিস্ময় মিশ্রিত প্রশ্ন ছিল হল পরিদর্শকের কাছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রত্যুত্তর : 'কিছুক্ষণ হলো খাতা জমা দিয়ে চলে গেছে।' কে সেই হুমায়ূন, তিন ঘণ্টার পরীক্ষা মাত্র দেড়-দুই ঘণ্টায় শেষ করে পরীক্ষা হল ত্যাগ করতেন?
কালক্রমে 'হুমায়ূন' হলেন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী স্বনামখ্যাত প্রফেসর হুমায়ূন কবির। ১৯২২ সালে নওগাঁ কেডি স্কুল থেকে খুবই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বাবা কবির উদ্দিন আহমদের সরকারি চাকরি সূত্রে হুমায়ূন কবির তখন ওই স্কুলে উচ্চতর শ্রেণী থেকে পড়াশোনা করতেন। হুমায়ূন কবিরের প্রকৃত নাম হুমায়ূন জহিরউদ্দিন আমির-ই-কবির। আদি নিবাস ফরিদপুর। জন্ম ১৯০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ার ফরিদপুরে। মৃত্যু ১৯৬৯-এর ১৮ আগস্ট কলকাতায়।
স্কুল-পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। এই কলেজ থেকে ইংরেজিতে লেটার মার্কসসহ আইএ পরীক্ষায় হুমায়ূন কবির তৃতীয় স্থান লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। অক্সফোর্ডের ঊীবঃবৎ কলেজে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে অনার্স পড়াশোনা করেন। ১৯৩১-এ অনার্স পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভের কৃতিত্বের অধিকারী হলেন। অল্প্রব্দ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সভাপতি (১৯৫০) এবং ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপদেষ্টা পদে (১৯৫২-৫৬) অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫৮-তে মাওলানা আজাদের মৃত্যুর পর তাকে শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন বিজ্ঞান গবেষণা ও সংস্কৃতি এবং পেট্রোলিয়াম ও কেমিক্যালস মন্ত্রী।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি আলীগড়, অন্নমালাই, বিশ্বভারতী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরস্কার লাভের গৌরব অর্জন করেন। প্রফেসর হুমায়ূন কবিরের পৈতৃক বাড়ি 'কবির বাগ' ফরিদপুরের আলীপুরে। সবুজ বৃক্ষরাজি বেষ্টিত মনোরম পরিবেশের এ ভিটেমাটি দর্শনার্থীর দৃষ্টি কাড়ে। সেখানে শ্বেতপাথরে খুদিত প্রফেসর কবিরের সনেট স্মরণ করিয়ে দেয় এ উপমহাদেশের অনন্যসাধারণ এক প্রতিভার কথা। স্বাধীনতা-উত্তরকালে কবির বাগের অনেকটা অংশজুড়ে স্থাপিত হয়েছে হুমায়ূন কবিরের মা-বাবার নামে 'সাজেদা-কবিরউদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ'। এখনও নওগাঁর কেডি স্কুল আছে। স্কুলের নয় দশককাল আগের একজন প্রাক্তন ছাত্রকে তার ১০৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরেক প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি, নিবেদন করছি তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। এই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক ও দার্শনিকের কথা আটপৌরে জীবনের কঠোর সংগ্রামে প্রায়ই ভুলে গেলেও দেড় ঘণ্টায় তার পরীক্ষা সমাপনের নৈপুণ্যের কথা যে ভুলতে পারছি না।

প্রফেসর এম শামসুর রহমান :সাবেক গণিত শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.