অভিমতঃ ‘ফাইল আটকানো যাবে না’— প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ কি রাজউকের বিশেষ ছাড়পত্র কমিটি আমলে নেয়? by ইকেবানা খান


প্রাসঙ্গিক কারণেই শুরুতে সুকুমার রায়ের একটি ছড়ার কিছু লাইন উল্লেখ করছি—

এসো এসো গর্তে এসো
বাস করে যাও চারটি দিন,
আদর করে শিকেয় তুলে
রাখবো তোমায় রাত্রি দিন।
আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার ৯ ছেলে
ঘচাং করে কামড়ে দেবে মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

ছোট বেলায় ছড়াটি পড়ে ভাবতাম কী জানি কখন কোনো গর্ত সামনে পড়বে আর অমনই যদি সেখান থেকে কিম্ভূতকিমাকার কিছু একটা বেরিয়ে এসে আমন্ত্রণ জানায়, তখন কী করব? কিন্তু এখন দেখছি এ দেশে বিশেষ করে খোদ রাজধানীতেই এ ধরনের বেশ বড় বড় গর্ত আছে, যা মানুষকে প্রতিনিয়ত কার্যক্ষেত্রে ভিত প্রদর্শন করে আসছে।
১/১১-পরবর্তী আমাদের দেশে যে গণতান্ত্রিক অবস্থা বিরাজ করছে তার তার বাইরে অবস্থান করছে রাজউক নামের সরকারি সংস্থাটি। সেখানকার সবাই এত বেশিমাত্রায় স্বাধীনচেতা যে ইচ্ছামত মতামত বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। যেন রাজউক আমাদের রাজধানীর হর্তাকর্তা বিধাতা। যদি কারও বাড়ি বা ভবন নির্মাণের ইচ্ছা থাকে, তবে ওই গর্তে তো যেতেই হবে আর যদি আবাসন ব্যবসায়ী হয় তবে তো কথাই নেই। অভিযোগ রয়ছে যে এই প্রতিষ্ঠান কোনো বিধিমালার তোয়াক্কা না করে মাসের পর মাস ফাইল আটকে রেখে মানুষকে জিম্মি করার নিত্যনতুন প্রক্রিয়া চালু করে চলেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন ‘ফাইল আটকাবেন না’, সেখানে এই নির্দেশ অমান্য করে রাজউকে চলছে ফাইল আটকে রেখে নিত্যনতুন পদ্ধতিতে হয়রানি।
রাজউক বিধিমালা ২০০৮-এর নিয়মনীতি মেনেই বর্তমানে সব নকশা অনুমোদন হয়ে থাকে। নকশা অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন কমিটি আছে। এসব কমিটি যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষমতাবান। এর মধ্যে প্রচণ্ড শক্তিশালী কমিটি হচ্ছে ‘বিশেষ প্রকল্প ছাড়পত্র অনুমোদন কমিটি’। রাজউক বিধিমালা ২০০৮-এর অধীনে সব ইমারত নির্মাণের প্রথম ও পূর্বশর্তই হচ্ছে প্রস্তাবিত রাস্তাকে বিবেচনায় এনে বা প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য শর্তপূরণ সাপেক্ষে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন করা। ওই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত রাস্তার কারণে যদি ভূমিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে ঋঅজ (Floor Area Ratio অর্থাত্ জমির ক্ষেত্রফলের অনুপাতে ভবনের সন্নিবেশযোগ্য সম্পূর্ণ মেঝের ক্ষেত্রফল) নিয়ম মেনে ওই ভূমির ক্ষতি পুষিয়ে দিয়ে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন করা হয়।

সব মেঝের সম্মিলিত ক্ষেত্রফল
অর্থাত্ FAR= (বিধিমালার মধ্যে ছাড়যোগ্য ক্ষেত্রফল ব্যতীত)
জমির ক্ষেত্রফল (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাস্তার জন্য ছেড়ে দেয়া জমির ক্ষেত্রফল ব্যতীত)

সে ক্ষেত্রে ওই বিশেষ প্রকল্পের ছাড়পত্র অনুমোদন কমিটি নামক শক্তিশালী কমিটি আছে তার সদস্যরা নিজ নিজ অধিদফতর বা ইনস্টিটিউটে এতটাই দীপ্তমান বিধায় তারা প্রধানমন্ত্রীর আদেশকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এখানে সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দুই পয়সাও মূল্য নেই। এই অবস্থায় আমজনতার দশা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অনেকেই জানেন, ওই কমিটির সদস্যরা কিছু নিয়মের মধ্যে নির্বাচিত হন—
১. সদস্য পরিকল্পনা, রাজউক— সভাপতি
২. নগর পরিকল্পনাবিদ (পরিচালক) রাজউক— সদস্য
৩. প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক— সদস্য
৪. স্থাপত্য অধিদফতরের প্রতিনিধি (উপ-প্রধান স্থপতি মর্যাদার), রাজউক— সদস্য
৫. ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের প্রতিনিধি— সদস্য
৬. ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের প্রতিনিধি— সদস্য
৭. বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের প্রতিনিধি— সদস্য
৮. পরিচালক (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ), রাজউক— সদস্য সচিব
ওই কমিটির সদস্যদের সমন্বয় ঘটান সদস্য সচিব। বর্তমানে এ কমিটির এখন এমন অবস্থা যে সাধারণ ভূমি মালিক বলেন আর আবাসন ব্যবসায়ী বলেন, সবাই সব সময় সুকুমার রায়ের ওই ছড়ার মতো আতঙ্কগ্রস্ত থাকেন। কারণ গর্তে তো যেতে হবেই, না গেলেও ভয় যে কোনো সময় ৯ ছেলে ও গিন্নীসহ ওই কিম্ভূতকিমাকার জিনিসটি কামড়ে দিতে পারে। যদি ফাইল বন্দি অবস্থায় রাখতে না চাই, চলমান বা বাঁচাতে চাই তবে তাদের কথা শুনে এগোতে হবে, নচেত নিয়ম মেনে চলা বা বিধি মোতাবেক নকশা করা হলেও তারা সে ফাইলে সর্বসম্মতি দিবে না। দেখা যায় বিধিমালার সব শর্তপূরণ করে নকশা জমা দেয়া হলো, তাতে সবার সম্মতি পাওয়া গেল কিন্তু শুধু একজন সদস্য সম্মতি না দেওয়ায় তা অনুমোদিত হলো না। এদিকে দেখা যায় একই ক্যাটাগরির ১০টি ফাইলে একটি অনুমোদন হলো, কিন্তু বাকি ৯টা বাতিল করা হলো। এ সবের কারণ আমাদের মতো সাধারণ মানুষরাও জানেন যে, সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি প্লানার্স ইনস্টিটিউটের নবীন সদস্য, যার ক্ষমতার দাপটে অন্য প্রবীণ সদস্যরাও কুপোকাত। আর সদস্য সচিব তো শক্তের ভক্ত নরমের জম। যদি কোনো ব্যক্তি তাদের খুশি করতে পারে তবে তারা ভুল করলেও ফাইল বাতিল হবে না। আর না হোক শ’খানেক ফাইল আছে, যা বিধিমালা মোতাবেক পরিচ্ছন্ন অথচ ওই সব ব্যক্তির মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সামান্য বিলম্ব ঘটলে দেখা যায় ফাইলটি নাকচ করে দিয়েছে অথবা ফাইলটি অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। সম্পূর্ণরূপে বিধিমালাকে পাশ কাটিয়ে তারা নিজেদের মনগড়া তথ্য দিয়ে ফাইলটি বন্ধ করে দেয়, নচেত মৃত্যু ঘটায়। সে ক্ষেত্রে সময়ের অপচয়ের খেসারত দিতে হচ্ছে আবেদনকারীকে। বিধিমালা মতে, ওই কমিটি সত্ উদ্দেশ্য নিয়ে অন্যের কাজকে সহজ করতে চেয়েছে বলে আমার ধারণা। কিন্তু ঘটছে তার ঠিক উল্টোটাই। আমার প্রশ্ন, আমরা কি কখনও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেবা বা সহযোগিতা পেতে পারি না? যদি এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়া হয়, ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় তবে স্বভাবতই প্রতিহিংসার জন্ম নেবে। ঠুটো জগন্নাথ হয়ে ওই কমিটিটি বিধিমালার রক্ষক হিসেবে থেকে যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও ওই দফতরের পূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে জানাই—এভাবে কিন্তু অনিয়ম জন্ম নিতে থাকবে।
বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.