রেডিও-টিভি চ্যানেলের ভাষা বিকৃতিতে ব্যথিত হই by তানজিয়া সবরিন মিসু

একুশের চেতনায় উজ্জীবিত এই জাতির জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে যখন দেখি মাতৃভাষার অবমাননা, ভাষা ব্যবহারের অসংগতি আমার এই তরুণ হৃদয় ব্যথিত হয় যখন একটি কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে বাংলাকে অবমাননা করা হয়, যখন রেডিও চ্যানেলগুলোতে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা না করে বিকৃত উচ্চারণ করা হয়, যখন বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশ্রিত কথা আধুনিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, যখন বিয়ের কার্ড বাংলায় করার চেয়ে ইংরেজিতে করাটা সম্মানের বহিঃপ্রকাশ,


যখন দোকানের নাম, সাইনবোর্ড, ব্যানারে বাংলা নামটাকেই ইংরেজিতে লেখা হয় আমি তখন বাকরুদ্ধ হই। এই আমার মায়ের ভাষা বাংলা! আমার হৃদয়ে তীব্র ক্ষোভ জন্মায়। যেখানে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে, সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সর্বস্তরে ব্যবহার বিধিত হয়েছে, যেখানে ভাষার সর্বোচ্চ সংরক্ষণের জন্য যুক্তফ্রন্টের ইশতেহার বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন উজ্জ্বল নক্ষত্র সেখানে উচ্চ আদালতে এ ভাষার অমর্যাদা যেই দেশে বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে একুশের চেতনা এবং তারই ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমী, সেখানে আমরা এখন জাতি হিসেবে ভাষা দুর্যোগের ঘূর্ণায়মান আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি।
আমরা যখন খুঁজেই পাই না আমাদের করণীয় কী? তখন জাতি হিসেবে নিজেদের বড় বেশি অসহায়, ব্যর্থ মনে হয়। অথচ বাংলা একাডেমীর রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা, যা মেনে চললে ভাষাকে সমৃদ্ধ ও সংরক্ষণ সম্ভব। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার ও গণমাধ্যমের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। আজকে আমরা দেখি প্রিন্ট মিডিয়ায়, পত্র-পত্রিকায় বানান বিচ্যুতি অথচ বাংলা একাডেমীর নির্দিষ্ট প্রমিত বানান রীতি থাকা সত্ত্বেও তা সংশোধন হচ্ছে না।
আমরা যখন দেখি দক্ষিণ এশিয়ার চীন, জাপান তাদের দেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে গেলে বাধ্যতামূলকভাবে দুটি ভাষা শিখতে হয় একটি তাদের মাতৃভাষা অন্যটি ইংরেজি। যাতে করে বহিরাগতরা ইংরেজি ভাষার বইগুলোকে তাদের মাতৃভাষায় রূপান্তর করে পড়তে পারে। অথচ আমাদের সরকারের এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি, বরং বিদেশের অপসংস্কৃতি যখন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে, আমরা তখন দেখি বিদেশি ভাষার তাণ্ডব নৃত্য, যার প্রভাব আমাদের ভাষার মূলে হানা দেয়, আর তখনই বাংলা ভাষার বিকৃতি সাধন হয়। বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের জীবনটা যখন বাণিজ্যিক রূপে পরিণত হয়েছে এবং আমরা যখন শুনি কোনো ছাত্র বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছে তখনই আমরা ধিক্কার এবং অবহেলা দৃষ্টিতে বলে উঠি বাংলা! সে আবার পড়ার কী হলো! এ হলো আমাদের বাংলা ভাষার বর্তমান প্রেক্ষাপট ও চালচিত্র। যদি বলি একুশ আমাদের জাতীয় চেতনার মানসপটে নতুন সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দেয়, তাহলে তারই ফল হলো আমাদের চেতনাপুষ্ট শিল্প-সাহিত্য। বাঙালি জাতীয় চেতনার উপলব্ধির ক্রমবিকাশ এখানে এসে গাঢ়তায় রূপ নেয়। এবং ৫২-এর সেই দিনে বাঙালি ছাত্র-জনতা, কুলি-মজুর, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী_সবাই ছিল সোচ্চার শুধু মায়ের ভাষায় কথা বলতে অথচ সেই ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাষাকে আমরা স্বীকৃতি দিতে আমাদের কুণ্ঠাবোধ হয়। তাদের প্রাইমারি শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে পারি আমরা তাদের ভাষা সংরক্ষণ করে, পাশাপাশি তাদের বাংলা ভাষা শেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। তাতে করে তারা বাঙালি হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে পারবে। যত দিন আমরা তাদের এ অধিকারটুকু দিতে না পারব তত দিন পর্যন্ত আমি বলব যে এটা আমাদের বড় অপারগতা, জাতি হিসেবে আমরা বড়ই সংকীর্ণ। আমি তাই বলব
'একুশে ফেব্রুয়ারি কোনো বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তিথি নয়, একটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগি্নগর্ভ। কখনো অন্তর্দাহে গর্জন করছে, আর কখনো চারদিকে অগি্ন ছড়াচ্ছে। সত্যি, এ ইতিহাস মৃত নয়, একেবারে জীবন্ত'
আমাদের উচিত এ অহংকার এ ইতিহাসকে ধরে রাখা এবং ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার ও তাৎপর্য রক্ষা করা এবং কোনো ভিনদেশি অপশক্তি যাতে আমাদের প্রাণের ভাষাকে ঘায়েল করতে না পারে সেদিকে সোচ্চার হওয়া, প্রয়োজন হলে আরো একটি ভাষা আন্দোলন হবে তবুও কারো কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেব না।

No comments

Powered by Blogger.