ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যে জাতীয়তাবাদ ছিল ভাষাভিত্তিক, তাকে আমরা বলি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এটা এখন পরীক্ষিত সত্য যে_ ধর্ম নয়, ভাষাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি।
আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা আছে কিন্তু তাই বলে এই রাষ্ট্রকে আমরা জাতিরাষ্ট্র বলব না। কেননা, এখানে ক্ষুদ্র আকারে হলেও অন্য জাতিসত্তার উপস্থিতি রয়েছে। বস্তুত আধুনিক বিশ্বে এক জাতি এক রাষ্ট্র_ এটা আর সম্ভব নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্জনের দিক হলো এই_ এটা এ দেশের মানুষকে ইহজাগতিক করে তুলেছে। রাষ্ট্রের পক্ষেও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া উচিত ছিল। যদিও রাষ্ট্র এখন তার ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে পারছে না। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সে মেনে নিয়েছে। অথচ রাষ্ট্র যে প্রধান দুই দল পালাক্রমে পরিচালনা করছে তারা উভয়ই নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বভাবতই বাংলা স্বীকৃত হয়েছে। এটা কেবল বাংলাদেশের বাঙালিদের জন্য নয়, সারাবিশ্বের বাঙালিদের জন্যই এটি গৌরবের বিষয়। কেননা, এই প্রথম একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
প্রত্যাশিত ছিল_ বাংলাদেশে বাংলা ভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম, কেবল প্রাথমিক স্তরে নয়, সর্বোচ্চ স্তরেও। আদালতের ভাষাও বাংলা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বাংলা হয়নি। উচ্চ আদালতেও বাংলার প্রচলন ঘটেনি। অন্যদিকে মান বাংলা আজ নানানভাবে আক্রান্ত। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা কথাবার্তায় ইংরেজি শব্দ ও বাক্যাংশ বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে অত্যন্ত স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেন। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ও অশিষ্ট শব্দ ব্যবহারেও তাদের মনোভাব বেপরোয়া। অন্যদিকে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে নাটক ও বিজ্ঞাপনে মান ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে। আকাশ প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে ঘরের ভেতর হিন্দি ভাষা চলে এসেছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। এক সময় পাকিস্তানিরা বাংলার সঙ্গে ফার্সি ও উর্দু মেশানোর চেষ্টা করেছিল_ আমরা তার প্রতিবাদ করেছি এবং বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আজ হিন্দির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই। উর্দুর বিরুদ্ধে

সংগ্রাম করতে গিয়েই আমরা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলাম। ভাষা হিসেবে উর্দু কিন্তু হিন্দির চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। এখন হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানিরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বলিউডের তারকাদের বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া করে এনে ব্যবসায়ীরা মুনাফা লাভের আয়োজন করছে। অন্যদিকে এফএম রেডিও যে ভাষা ব্যবহার করে সেটার মান বাংলা ভাষা থেকে অনেক দূরে। যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে, সেখানে জাতীয় সংসদে সদস্যরা যেসব বক্তৃতা দেন_ সেগুলো অনেক সময় সাহিত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের এখানে সংসদীয় বক্তৃতাকে মান বাংলার বিকৃতি ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই। জনসভায়ও একই রকম বিকৃতি চলে। অথচ রাজনীতিবিদদেরই হওয়ার কথা পথপ্রদর্শক। তাদের আচরণ ও ভাষা ব্যবহার দেখেই সাধারণ মানুষ নিজেদের ভাষা ব্যবহারের মান ঠিক করবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা খুব ভালো অবস্থায় নেই। শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিত্তবান সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, গরিবরা যাচ্ছে মাদ্রাসায়। আর মধ্যবিত্ত বিদ্যায়তনে যে বাংলার চর্চা করে তাতেও ব্যাকরণ ও উচ্চারণ কোনোটার শুদ্ধতার ওপরই জোর দেওয়া হয় না।
শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, বইমেলায় প্রচুর বই বের হয় প্রতি বছর_ কিন্তু বাংলা ভাষার অবস্থা যে ভালো নেই সেটা একটা মর্মান্তিক সত্য। ভাষা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা ব্যবহারের মধ্যে যেমন একজন মানুষকে চেনা যায়, ভাষার সাধারণ অবস্থা দেখেও দেশের সংস্কৃতির হালহকিকত সম্পর্কে টের পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে এখন প্রায় সব দিক দিয়েই নৈরাজ্য চলছে। বাংলা ভাষার অপব্যবহারও সেই নৈরাজ্যেরই অংশ। স্বাধীনতা মানে, যার যা ইচ্ছে করার সুযোগ বলে মনে করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে যতটা অকার্যকর, ভাষার ক্ষেত্রে তার চেয়ে অধিক দুর্দশাগ্রস্ত।
ভাষাকে কেবল উপর কাঠামোর অংশ ভাবলে ভুল করব। ভাষা আসলে সমাজের মূল কাঠামোরই অংশ। ভাষার মধ্য দিয়েই আমরা নিজেকে প্রকাশ করি এবং অন্যের সঙ্গে যুক্ত হই। ভাষার যোগাযোগ, যান্ত্রিক যোগাযোগের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। ভাষার দক্ষতা অন্য দক্ষতার মধ্যে প্রতিফলিত হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই হচ্ছে সবচেয়ে স্বাভাবিক গভীর ও স্থায়ী। শিক্ষায় মাতৃভাষার যথার্থ ব্যবহারে আমরা যে পরিমাণে ব্যর্থ হচ্ছি_ আমাদের সমষ্টিগত অগ্রগতিও ততটাই পিছিয়ে পড়ছে। ভাষা মানুষকে সামাজিক করে। বাংলা ভাষার অযথার্থ ব্যবহার আমাদের সামাজিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায়। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা। কিন্তু এখানে শিক্ষা যে তিন ধারায় বিভক্ত তাতে শ্রেণী বিভাজন আরও গভীর ও বিস্তৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা উপকার না করে বরং অপকারই করছে। আজকে বাঙালি বলে মানুষ যে কুণ্ঠা প্রকাশ করে_ সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সময় এটা ছিল অকল্পনীয়।
দুর্নীতিপরায়ণতায় পৃথিবীতে বাংলাদেশ এখন শীর্ষস্থানীয়। তার শেয়ারবাজার বিশ্বে নিকৃষ্টতম। সড়কগুলো চলাচলের চেয়ে দুর্ঘটনা সৃষ্টিতে অধিক উপযোগী। আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত ভয়াবহরূপে রক্তাক্ত, আমাদের সীমিত খনিজসম্পদ বিদেশিরা দখল করার জন্য তৎপর। আমরা আমাদের সমুদ্রসীমাকে চিহ্নিত পর্যন্ত করতে পারিনি। এসব ঘটনা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। আমরা একে মেনে নিচ্ছি। আমরা একটা কোণঠাসা জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছি। বাংলা ভাষার যে অপ্রচলন ও বিকৃতি_ তা এই সামগ্রিক সংস্কৃতিরই অংশ বটে।
সংস্কৃতির মূল কথাটা হচ্ছে, মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ানো। কিন্তু তা পারছে না। বাঙালি আগে যেমন, এখনও তেমনি একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবেই রয়ে গেছে। যদিও সংখ্যার দিক থেকে তার পরিমাণ ২৬-২৭ কোটিতে পরিণত হয়েছে। বাংলা, পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রাদেশিক ভাষা মাত্র। তাই বাংলা ভাষার জন্য ভরসার জ

No comments

Powered by Blogger.