হিন্দি ভাষার নীরব আগ্রাসন শুরু হয়েছে by জাহিদ আল-হেলাল

অন্যদের থেকে আমাদের ভাষার স্বাতন্ত্র্য একটি ক্ষেত্রে স্পষ্ট। তা হলো, বাংলা ভাষা আমাদের কাছে শুধু সৃষ্টিশীল জাতীয় প্রত্যয়ের স্থাপত্যই নয়, জাতি হিসেবে সবাইকে জাতীয় স্বার্থের বৃহত্তর মোহনায় সম্মিলিত করা এবং জাতি-ধর্ম-বিশ্বাস নির্বিশেষে সবাইকে জাতীয়তার সূত্রে আবদ্ধ করার মহান লক্ষ্যে বিশিষ্ট স্থপতিও বটে।


অন্য কোনো জনপদে এমনটি ঘটেনি। আমাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এখানটায়ই। একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্যও তা-ই। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬০ বছর পরও একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতি স্মরণ করে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে_শ্রদ্ধাবনত বা তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্তভেজা অর্জনের জন্য। কারণ, বাংলা ভাষার বহমান শক্তিমত্তা বাঙালির যেমন স্থায়ী অহঙ্কার, তেমনি তা আমাদের সময়োপযোগী বিবর্তনেরও আসল বাহন। একুশ তথা জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই পরিচয় বাংলাদেশের জনগণ নিজেরাই নির্দিষ্ট করেছে নিজেদের জন্য। এর জন্য অবশ্য অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে আমাদের এই অর্জনকে আজীবন ধরে রাখতে ৭০০ কোটি মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক তথ্য পেঁৗছাতে হবে। এ জন্য বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণাকর্মগুলো আন্তর্জাতিক পাঠের উপযোগী করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম রাদিচির মতো অভিজ্ঞ পণ্ডিতদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি দেশের প্রতিটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষাশহীদদের নামে ছাত্রাবাস, গ্যালারি কিংবা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা যেতে পারে। ভাষাকে সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধ করতে আর্কাইভে ভাষা বিশেষজ্ঞদের শুদ্ধ ভাষার ওপর গ্রন্থ বা সিডি রাখা যেতে পারে। দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রমিত বাংলা ভাষার বিস্তারে শিল্পকলা একাডেমীকেন্দ্রিক কর্মশালার আয়োজন করা যায়। প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষার ওপর স্থায়ী পাঠদান করা যেতে পারে। তা ছাড়া বাংলা ভাষার ওপর কাজ করছে_এমন আবৃত্তি সংগঠনগুলোকে কারিগরি সহায়তা দিলে তাদের কার্যক্রমগুলো আরো বেগবান হবে। বিশেষ করে বাংলা ভাষার প্রকৃত ইতিহাস ও চর্চাকেন্দ্রিক গ্রন্থ রচনায় সরকারি অনুমোদন থাকলে ভাষার প্রাণ বাঁচাতে তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। বর্তমানে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব অসংগতি অহরহ চোখে পড়ছে, তা হলো, সরকারি কাগজপত্রে, বিশেষ করে রেডিও-টেলিভিশনে যে ধরনের ভাষার অপব্যবহার, তাতে মূল অর্থটাই আড়ালে ঢাকা পড়ছে। বিদেশি ভাষার প্রতি আকর্ষণ, সাইনবোর্ডগুলোতে ইংরেজির সয়লাব এবং বাংলার ভেতর ইংরেজি ঢুকিয়ে বলাকে এলিট শ্রেণীর একটা স্টাইল হয়ে উঠছে। ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাথমিক শ্রেণী থেকেই বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে কোমলমতি শিশুদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বর্তমানে একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্প্রচারিত টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আরেকটি বিদেশি ভাষা অর্থাৎ হিন্দি ভাষার নীরব আগ্রাসন শুরু হয়েছে, যেখানে আমরা পুরো পাকিস্তানে প্রভাবিত হিন্দি ভাষা দ্বারা আবার আগ্রাসনের শিকার হতে যাচ্ছি। সরকারসহ সর্বস্তরের জনগণের বিদেশি এবং ভিন্ন সংস্কৃতি প্রভাবিত হিন্দি সংস্কৃতির নয়া আগ্রাসনের ব্যাপারে এখনই সোচ্চার হওয়া উচিত। বিগত এক হাজার বছর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলা ভাষা আজ আমাদের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ আজ বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু বাংলা ভাষা বিকাশের ধীরগতির পাশাপাশি চলছে হিন্দি ভাষার সরব আগ্রাসন। তাই সরকারি উদ্যোগে বাংলা ভাষার বিকাশ এবং তা সর্বস্তরে চালু করার পাশাপাশি দেশে অন্য যেকোনো বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অবশ্য সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সাধারণ জনগণকেও বাংলা ভাষা এবং আমাদের সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে যেকোনো বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং চর্চা করা_এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক আবশ্যক। আমরা সংগ্রাম করে আমাদের যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি, তা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে হবে। ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিও আমাদের উচিত হবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। সাম্প্রতিক সময়ে তারাও এ ব্যাপারে সোচ্চার হচ্ছে। পরিতাপের বিষয় হলো, এ দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ বাংলা ভাষা পড়তে কিংবা লিখতে জানে না। অর্ধেক জনসংখ্যাকে নিরক্ষর রেখে আমাদের এই ভাষা দিবস পালন কোনো তাৎপর্য বহন করতে পারে না। উচ্চতর আদালতে বাংলার ব্যবহার নেই, উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা আজও তার মর্যাদা পায়নি। নিজের মাতৃভাষা দখলে না থাকলে অন্য যেকোনো ভাষাই আমরা শিখি না কেন, তাতে আমাদের চিন্তাসৃজনশীলতার বিকাশের পথ রুদ্ধ হবে। স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে নিজ ভাষাকে পরিচয় দিতে হবে। আমরা অন্য ভাষা অবশ্যই শিখব, তবে বাংলা ভাষাটা আগে, তারপর অন্যসব। যেদিন বাংলাদেশের সব মানুষ বাংলা ভাষা লিখতে পারবে, পড়তে পারবে, সেদিন একুশের মূল চেতনা বাস্তবায়িত হবে।
« পূর্ববর্তী সংবাদ
       
পরবর্তী সংবাদ »
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনার মতামত দিতে এখানে ক্লি

No comments

Powered by Blogger.