২০০৯-এর সাত-পাঁচ (১) by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

যাক, একটা বদল অবশেষে হলো। ২০০৯ সাল বদলে গিয়ে ক্যালেন্ডারে এলো ২০১০। ২০০৯-কে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না স্মৃতির ঝুড়িতে ছাড়া। কেমন গেল ২০০৯ তা খোঁজার জন্য নিজের দুর্বল স্মৃতিশক্তির ওপর চাপ না বাড়িয়ে ২০১০ সালের প্রথম দিনের পত্রপত্রিকার শরণাপন্ন হওয়া ভালো বলেই মনে হচ্ছে। 
২০০৯-কে নিয়ে অনেক সাত-পাঁচ মতামত লিখেছেন অনেকেই এবং অবশ্যই সাত-পাঁচ ভেবেই লিখেছেন। সাত-পাঁচ শব্দটি অবশ্য এখন আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ১২ মাসে বছরের সময় এগোনো-পেছানো এখন থেকে ওই ৭-৫ মাসের হিসাবেই হবে। প্রথম বদলানোর কাজটা যদি একটু সাত-পাঁচ ভেবেই করা হতো, তাহলে ভোগান্তিতে পড়া স্কুলগামী বাচ্চা এবং তাদের মাতাদের অমন দুর্ভোগেও পড়তে হতো না আর সরকারকেও এই মর্মে গালি খেতে হতো না যে, ‘আদেখলের উঠলো বাই—আম ছালা তার সবই চাই’ বচনেই তো আছে ‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।’ সরকার এই বচনের প্রথমাংশ না মানলেও দ্বিতীয়াংশ অবশ্যই মেনেছেন। তাই ‘করিয়া’ আর ভাবাভাবির ধার ধারেনি। অবশ্য নতুন বছরের শুরু হয়েছে আবার সময় বদলের মাধ্যমে। একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই ওঠে, এই এগোনো-পেছানোর কি তেমন প্রয়োজন আছে এদেশে? পার্শ্ববর্তী ভারতে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সূর্যের অবস্থানের তারতম্য ঘটে ১ ঘণ্টারও বেশি। তার পরও সেদেশের স্থানীয় সময় একটাই এবং শীত-গ্রীষ্মে সেই নির্ধারিত সময় এগোয় বা পেছায় না। হ্যাঁ, বিশ্বের বেশকিছু শীতপ্রধান দেশে সময়ের রদবদল হয়। সেসব দেশে শীতে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে বেলা ৩টার পর পরই, আর গ্রীষ্মে রাত ১০টাতেও সূর্যের আলো বর্তমান থাকে। আমাদের এই ছোট আয়তনের দেশটির অবস্থা কিন্তু তেমন নয়। তা ছাড়া এদেশের শতকরা আশিজন মানুষ ঘড়ি দেখে চলেন না—চলেন বেলা দেখে। ঘড়ির কাঁটার বদলে তার কিছুই আসে-যায় না। সূর্যের আলোর বেশি ব্যবহার এবং বিদ্যুত্ বাঁচানোর কথা বলে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নিলেও গত এক বছরে বিন্দুমাত্র সাশ্রয় হয়েছে বলে তো মনে হয় না। ‘দিন বদল’ এবং ‘সময় বদল’ নিয়ে অনেক কথা গত বছর হয়েছে বলেই এ প্রসঙ্গে এত কথার অবতারণা। গত বছরের স্মরণীয় টুকরো কথার মধ্যে একটি হলো সংসদে ‘বিরোধী দলের মতো’ কথা না বলার জন্য নিজদলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হুশিয়ারি। আইন প্রতিমন্ত্রী যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মামলা তুলে নেয়ার জন্য ক্ষমতার চেয়ারে বসেননি। এই বক্তব্যও গুরুত্বের। ২০০৭-এর ১১ জানুয়ারির অবৈধ সরকার ঢালাওভাবে রাজনৈতিক নেতাদের নামে মামলা দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের সব মামলা তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করলেও বিএনপির কোনো মামলা তোলা হয়নি। তার বক্তব্যের কারণেই মনে হয়েছে, তিনি বোধহয় শুধু সরকারদলীয় মামলা তুলে নেয়ার জন্যই ওই আসনে বসেছেন—আর কোনো কাজ নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী তো যতবার দ্রব্যমূল্য নিয়ে হুঙ্কার দিয়েছেন ততবারই তা বেড়ে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়া ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে যা বলেছেন এবং যা বাস্তবে ঘটেছে—তা দেশের মানুষ শুধু নয়, উচ্চ আদালত পর্যন্ত দেখেছেন এবং বাধ্য হয়েছেন স্বপ্রণোদিতভাবে রুল জারি করতে। আওয়ামী লীগের ভূতপূর্ব সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের কাণ্ড নিয়ে তো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড লেখা দেখেছি। এ প্রসঙ্গ থাক। গত বছরের সালতামামির নানা লেখা দেখতে দেখতে একটি পত্রিকার একটি নিবন্ধের শিরোনাম দেখে আকৃষ্ট হলাম। ২০০৯ : ‘অতিক্রান্ত হলো প্রশান্তির একটি বছর।’ প্রশান্তির কথা বলতে গিয়ে নিবন্ধকার প্রথমেই হোঁচট খেয়েছেন দ্রব্যমূল্যে। আমতা আমতা করে হলেও তাকে বলতে হয়েছে, ‘আদা-রসুন-ডাল-চিনির দাম এ মুহূর্তে অত্যধিক। এ সরকার আসার পর আদা ছিল ৫০-৫৫ টাকা, যা এখন ৮৫-৯০তে উঠেছে। ৪০-৪৫ টাকার রসুন এখন ৮০-৯০ টাকা, ৩৫-৩৬ টাকার চিনি এখন পঞ্চাশ টাকা।’ এই তুলনাও কিন্তু অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের সময়ের সঙ্গে। বিগত জোট সরকারের শেষ সময়ের সঙ্গে তুলনার সাহস করলে তিনি দেখতে পেতেন, যে ডিমের দাম কমেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন তার বর্তমান হালি ২০০৬-এর ডজনের দামের সমান। ৪০ টাকার ডাল এখন ১৪৫ টাকা। কোনো দ্রব্যের দামই বিগত জোট সরকারের সময়ের দামের তুল্য নয়। বিগত বছরে আমরা খবরে দেখেছি, চাষি বাধ্য হচ্ছে ৭৫ পয়সায় মূলা বিক্রি করতে, যা শহরে বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকায়। মধ্যস্বত্বভোগীরা কোন আনুকূল্যে চাষীর রক্তঘাম চুষেছে এবং শহুরে ক্রেতার পকেট মেরেছে, সে দৃশ্য তিনি দেখেননি। তিনি বিগত জোট সরকার আমলের হত্যাকাণ্ডগুলোর কথা তুলে ধরেছেন, কিন্তু বেগতিক হবে বলেই বোধহয় তার আগের গডফাদারদের কথা এবং তাদের অবলীলায় মানুষ হত্যার কথা তোলেননি। তিনি জঙ্গিবাদের কথা এনেছেন, কিন্তু ভুলে গেছেন এ কথা বলতে যে, বিগত জোট সরকারের আমলেই প্রধান প্রধান জঙ্গি নেতার গ্রেফতার, বিচার ও ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। তিনি অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতির অভিযোগের ঢোলটা আবার বাজিয়েছেন। কিন্তু এ কথা বলেননি যে, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ কতজনের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগে মামলা ছিল। ক্ষমতায় এসে কোন প্রক্রিয়ায় সেসব মামলা গায়েব হয়ে যাচ্ছে!


হ্যাঁ, অনেকের কাছেই ২০০৯ প্রশান্তির বছর। বছরের শুরুতেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারের মৃত্যু এবং বিডিআর বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাওয়া যাদের কাছে উল্লেখযোগ্য নয়, ২০০৯ সাল তাদের কাছে প্রশান্তির তো হবেই। ২০০৯-এর ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির এ নারকীয় ঘটনার সত্যিকার কোনো প্রতিকার কি হয়েছে? এ বিষয়ে ১ জানুয়ারির আমার দেশ-এ প্রকাশিত ‘২০০৯ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা পিলখানা হত্যাকাণ্ড’ নিবন্ধটির জন্য জাহেদ চৌধুরীকে ধন্যবাদ। তবে এ নিয়ে এবং এ ছাড়াও আরও কথা আছে, যা পরবর্তীকালে বলার ইচ্ছে রইল।
লেখক : কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.