বাংলা ভাষায় প্রয়োগবিজ্ঞানের প্রাণপ্রবাহ by মুহম্মদ সবুর

জাতির স্বাজাত্যবোধ ও স্বকীয়তার প্রথম এবং প্রধানতম সত্তা ভাষা। এই ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো দুই পারের মাঠ উর্বর করে পলি দিয়ে- ভাষাও তেমনি চারদিক থেকে শব্দভাণ্ডার গ্রহণ করে তার সমৃদ্ধির জন্য, তার পরিপুষ্টির জন্য। ভাষার আছে নানা দিগন্ত, আছে প্রাণপ্রবাহ। গতি তার অপরিসীম। ভাষার অন্তরে থাকে মানুষের বিশ্বাস ও আচরণের ভাবপ্রকাশ।


ভাষা প্রবাহিত হয় তার ভেতরের ভাষার জৈবিক নিয়মের জোরে। ভাষাবিষয়ক ভাবনাচিন্তা বা আলাপ-আলোচনার যেমন আছে নানা দিক, তেমনি তার পরিসরও বহু। সময় অধিকরণ ভেদে একই পরিসরের আবার বিভিন্ন চেহারা থাকে। এই চেহারা উম্মিলিত হয় ভাষাবিজ্ঞানের মাধ্যমে। এই বিজ্ঞানের বিধিবিধান আর বিস্তারে ভাষাতাত্তি্বক অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন বৈচিত্র্যের অভীপ্সায়। ভাষাবিজ্ঞানে ভাষা সংগঠন, ভাষার রূপ, ধ্বনি, বাক্য এবং অর্থের সন্ধান করা হয়। ভাষাবিজ্ঞানের মূল কেন্দ্রীয় শাখা চারটি নির্ধারিত ছিল। যেমন- ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব ও বাগর্থবিজ্ঞান। এর সঙ্গে নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে আরেকটি মূল শাখা প্রয়োগবিজ্ঞান বা প্রায়োগিক বিজ্ঞান। অর্থাৎ তত্ত্বগত বিশ্লেষণ নয়, ভাষার প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক বিশ্লেষণে এই বিজ্ঞানকে আশ্রয় করতে হয়, যার কাজই হচ্ছে ভাষার প্রাসঙ্গিক বা ব্যবহারগত অর্থ নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণ। ধ্রুপদী তত্ত্বে ভাষা হচ্ছে শক্তির প্রকাশ। শক্তির তাত্তি্বক সূত্রটি মূলত ভাষাদর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভাষা হচ্ছে প্রকৃতির মতো চঞ্চল। অর্থাৎ পরিবর্তনশীল। আর সে কারণেই সে নিয়ত নতুন রূপ আশ্রয়ী। বাস্তবতা হচ্ছে, ভাব ও ভাষার সার্বিক একাত্মতা কখনোই সম্ভব হয় না। কারণ ভাষার পরিবর্তন এবং নতুন রূপ লাভের উদ্দেশ্য একটাই, তা হচ্ছে ভাবের সঙ্গে ঐক্য বা মিলন রচনা করা। কিন্তু সার্বিক ঐক্য সম্ভব হয় না। ভাষার পরিবর্তনশীলতার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে আঙ্গিক বা প্যাটার্নের সম্পর্ক। বিশেষত, ভাষার বিকাশকে প্রাগ্রসর করেছে ভাষাবিজ্ঞান। কেনো নির্দিষ্ট ভাষার নির্দিষ্ট সময়ের বৈশিষ্ট্যের আলোচনা ও বর্ণনা এবং কোনো নির্দিষ্ট ভাষার বিভিন্ন সময়ের বিবর্তন ও পরিবর্তনের ধারা বিচার-বিশ্লেষণ করে ভাষাবিজ্ঞান বিশ্লেষণের কাজ চলে আসছে। প্রায়োগিক বা প্রয়োগবিজ্ঞান ভাষাবিজ্ঞান চর্চার আরেক সুফসল বলা যায়, যা বাংলা ভাষার সুচারু বিকাশের সহায়ক হিসেবেই বিধৃত হচ্ছে।
ভাষাবিজ্ঞানের দিগন্ত ক্রমেই প্রসারিত বা বিস্তারিত হচ্ছে। তাত্তি্বক ভাষাবিজ্ঞান, ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, সমাজ ভাষাবিজ্ঞান, ভাষাশৈলীবিজ্ঞান, বাগর্থবিজ্ঞান, অভিধানবিজ্ঞান, মনোভাষাবিজ্ঞান, গাণিতিক ভাষাবিজ্ঞান, কাঠামোগত ভাষাবিজ্ঞান, উক্তিমালা বিশ্লেষণ। এসব ভাষাবিজ্ঞানের শাখার সঙ্গেই সংযোজিত হয়েছে প্রায়োগিক বা প্রয়োগ ভাষাবিজ্ঞান। উল্লিখিত ভাষাবিজ্ঞানের অনেক শাখা প্রয়োগবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। প্রয়োগবিজ্ঞানের জ্ঞান মানুষের ভাষা ব্যবহারকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে সাহায্য করে। প্রয়োগবিজ্ঞানে ভাষাকে বুঝতে হয় প্রাকৃতিক বিশ্বের বা শরীরবৃত্তীয় অংশ হিসেবে। খুব স্বাভাবিকভাবে মানব মস্তিষ্ক যে সহজাত ক্ষমতায় ভাষা ব্যবহার করে এবং বোঝে সেই ক্ষমতাকে। এই ভাষা জানা-বোঝা-ব্যবহার করার পরিসর হচ্ছে ভাষিকবৃত্ত। এই ভাষিকবৃত্ত আবার বিষয়ী বক্তব্য তৈরি করতে পারে। এই করতে পারার বিমূর্ত বয়ান হচ্ছে 'ইনটারলাইজড' ভাষা। এই কৌশলেই বিষয়ী বানিয়ে নেয় ভাষার সংগঠনিক বিবরণগুলো। এই বিবরণগুলোই ভাষার 'এঙ্প্রেশান'। প্রত্যেক মানুষই সসীম শব্দ দিয়ে অসীম বাক্য বানাতে পারে, যা তার সহজাত।
'প্রয়োগবিজ্ঞান হচ্ছে ভাষিক প্রকাশ এবং এদের ব্যবহারকারীর মধ্যকার সম্পর্কসংক্রান্ত বিদ্যা।' এমন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন জিওফ্রি লিস। ডেভিড ক্রিস্টালের মতে, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় যেসব বিষয় ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বক্তার বাছাই বা পছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এসব বাছাইয়ের ফলে অন্যের ওপর যে প্রভাব পড়ে সে প্রভাব নিয়ন্ত্রণকারী বিষয়গুলো প্রয়োগবিজ্ঞানের বিষয়। ভাষা ব্যবহারকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে যখন ভাষা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখন তাকে বলা যায় প্রয়োগবিজ্ঞান। ব্রুস ফ্রেসার একজন ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি মূল্যায়ন করেছেন যে ভাষিক যোগাযোগের তত্ত্ব হচ্ছে ভাষাবিজ্ঞান। ভাষিক যোগাযোগ বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, যে পরিস্থিতিতে বক্তা শ্রোতার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সংগঠিত হয় সে পরিস্থিতি। ভাষিক যোগযোগ তখনই সফল হয়, যখন শ্রোতা বক্তার অভিপ্রেত বা মনোভঙ্গি অনুধাবনে সক্ষম হয়। অপর ভাষাবিজ্ঞানী জর্জ ইয়ুলের মত হচ্ছে, বক্তার অর্থসংক্রান্ত পঠন-পাঠন প্রয়োগবিজ্ঞানের বিষয়। বক্তা কোন অর্থটি প্রকাশ করতে চাচ্ছে, তা লক্ষ ও বিশ্লেষণ করাই প্রয়োগবিজ্ঞানের কাজ। জি ল্যাকফ গুরুত্ব দিয়েছেন ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে প্রয়োগবিজ্ঞান লক্ষ্য করে। ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষাকে দেখার কাজটিই প্রয়োগবিজ্ঞানকে করতে হয়। প্রয়োগবিজ্ঞানের আলোচনার প্রসারকে নির্দেশ করার লক্ষ্যে চার ধরনের প্রয়োগবিজ্ঞান নির্ধারণ করেছেন ডেভিড ক্রিস্টাল। ভাষিক প্রয়োগবিজ্ঞান, সামাজিক প্রয়োগবিজ্ঞান, সাধারণ প্রায়োগবিজ্ঞান ও প্রয়োগিক প্রয়োগবিজ্ঞান। ভাষাতাত্তি্বক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে আলোচনা করে ভাষিক প্রয়োগবিজ্ঞান। প্রয়োগবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও অর্থের আলোচনা সংগঠনকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা দেখে এই ভাষিক প্রয়োগবিজ্ঞান। ভাষা সংগঠনকে কেন্দ্র করেই ভাষার অর্থকেন্দ্রিক আলোচনাই এর কাজ। সামাজিক প্রয়োগবিজ্ঞান দেখে ভাষা ব্যবহারকে কিভাবে সামাজিক নিয়মরীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ প্রয়োগবিজ্ঞান যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারে যেসব সাধারণ রীতিনীতি মানা হয়, সেসব রীতিনীতি আলোচনা করে। আর প্রতিকূল পরিবেশে ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগ কিভাবে সফল ও ফলপ্রসূ করা যায় তা প্রয়োগিক প্রয়োগবিজ্ঞান আলোচনা করে। প্রয়োগিক প্রয়োগবিজ্ঞানের ধারণা, একজন মানুষের ভাষা ব্যবহারকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে সাহায্য করে। বাংলাদেশে প্রয়োগ ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা নামমাত্র। যদিও বিশ শতকের শেষে এই বিজ্ঞান বিকশিত হয়ে ওঠে। প্রয়োগবিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে আসছে সেই ১৯৮৫ সাল থেকে। সে সময়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক প্রয়োগতাত্তি্বক সমিতি। বাংলাভাষা চর্চার বিকাশে প্রয়োগভাষাবিজ্ঞানের চর্চার বিকাশ ঘটা খুব সহজসাধ্য নয়। ভাষা প্রয়োগসংক্রান্ত সমস্যাবলি নিয়ে ইউরোপসহ অন্যান্য দেশগুলোতে চর্চা ক্রমেই বেড়েছে। বাংলা ভাষাবিজ্ঞানীরা এই বিজ্ঞানকে আরো বিকাশের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন এমন প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক
saburma96@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.