সাদাকালো-অঞ্চলটা যখন তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য by আহমদ রফিক

যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি, বলা চলে আগ্রাসী আধিপত্যবাদী নীতি আর বদলাবে না। সেখানে শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ, ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান_যেমন প্রেসিডেন্টই দেশ শাসন করুক না কেন, চিত্র একই থাকতে হবে। বারাক ওবামার নির্বাচনী ইশতেহার, তাঁর প্রতিশ্রুতি ও কথাবার্তা অনেককে আশান্বিত করেছিল।


কিন্তু যাঁরা মার্কিন রাজনীতির অন্দরমহলের খবর রাখেন তাঁরা অবশ্য এ বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের সন্দেহ সত্য হয়েছে। ইরাক থেকে আফগানিস্তান, এমনকি ইহুদি বনাম ফিলিস্তিনের মতো বিষয়াদি নিয়েও ওবামার নীতি ও কার্যক্রম প্রমাণ করে দিচ্ছে যে তিনি বুশ-ধারাবাহিকতার করপোরেট শক্তি ও ইহুদি লবিরই সমর্থক, ওদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা তামিল করার শাসক।
বেশ কিছুদিন থেকে মধ্যপ্রাচ্য সরগরম, সেখানে একের পর এক ব্যাপক তোলপাড়। শুরুটা তিউনিসিয়া দিয়ে। এরপর মিসর হয়ে ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া সর্বত্রই ব্যাপক গণ-অসন্তোষ ও গণ-আন্দোলন। নিরস্ত্র প্রতিবাদ সশস্ত্র আন্দোলনে পরিণত। মৃত্যু ও রক্ত প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিক্ষোভের ছোঁয়া লেগেছে খোদ সৌদি আরবেও, পরাশক্তি-বংশবদ আরব দেশে।
কিন্তু লক্ষ করার বিষয় যে মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশ মার্কিন নীতির ঘোর বিরোধী, আন্দোলন সেসব দেশেই জমে উঠেছে। মিসরে ইসরায়েল-সমর্থক হোসনি মুবারকের দীর্ঘ একনায়কসুলভ শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলন সত্ত্বেও সেখানে শান্তির বাণী ছড়ানো হয়েছে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে। স্বনামখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন তাঁর একাধিক লেখায়।
প্রেসিডেন্ট ওবামার চেষ্টা সত্ত্বেও শেষরক্ষা হয়নি। হোসনি মুবারককে পদত্যাগ করতে হয়েছে, নির্বাসনে যেতে হয়েছে, এখন বিচারের সম্মুখীন। কিন্তু এ ওবামাই লিবিয়ার বিক্ষোভ নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন নীতির অনুসারী। এখানে শান্তি নয়, যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধ অর্থবহ করে তুলতে ইঙ্গ-ফরাসি-ইতালির মতো সতীর্থদের নিয়ে জাতিসংঘকে জাগিয়ে তোলেন। আকাশ অবরোধ থেকে অস্ত্র সরবরাহ বিদ্রোহীদের। তাতেও সুবিধা হচ্ছে না দেখে সরাসরি হামলা, ন্যাটোকে হামলার দায়িত্ব দিয়েও স্বস্তি মিলছে না। আফগানিস্তানের মতো লিবিয়ায় চালকবিহীন বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়াশিংটন এবং তাদের হামলায় বেসামরিক লোকজন যে মারা যাবে, তা প্রায় নিশ্চিত। আফগানিস্তান এর প্রমাণ।
'অহিংস আন্দোলনের নৈতিক শক্তির প্রবক্তা' বারাক ওবামা (মিসরে বক্তৃতা) এখন সহিংস শক্তিপ্রয়োগের পক্ষে। কারণটা গাদ্দাফির লিবিয়া। গাদ্দাফির মার্কিন-বিরোধিতার কথা বহুল প্রচারিত। এবার তাঁকে 'সিধে' করার মওকা এসে গেছে। এ সুযোগ কি মার্কিন যুদ্ধবাদীরা কখনো ছাড়তে পারে? তাই লিবিয়ার বিদ্রোহীদের ব্যাপক সাহায্য_অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ; ঠিক যে কাজটি একদা করা হয়েছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির অবসান ঘটাতে।
লিবিয়ার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী আন্দোলন তাই পরাশক্তিদের কল্যাণে গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। আর সেখানকার জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে সে গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাগরেদ ন্যাটো বাহিনী। ওবামার মতে, লিবিয়ায় এক অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, কিন্তু করছে না গাজায় ইহুদিদের লাগাতার হামলায়। এমনকি ইয়েমেন বা সৌদি আরবের জনবিক্ষোভ দৃশ্যত তাদের অস্বস্তির কারণ নয়। বরং বশংবদ সৌদি শাসকদের সংকটমুক্ত করার ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন, লিবিয়ার জনবিক্ষোভ কি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়? সেখানে নাক গলানোর এবং হামলা চালানোর নৈতিক বা রাজনৈতিক অধিকার কি ইঙ্গ-মার্কিন লবির রয়েছে? একাত্তর সালে বাংলাদেশে সংঘটিত জনসংগ্রামকে তো নিঙ্ন প্রশাসন 'পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়' বলে গণহত্যার বিরুদ্ধে জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব নেয়নি? বরং পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সাহায্য করেছে ভারত-বিরোধিতার ধুয়া তুলে। তাদের দেশেরই পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু ওয়াশিংটনের মানবহিতৈষণার কোনো প্রকাশ দেখা যায়নি। কিন্তু লিবিয়ায় তো রয়েছে বিশাল তেলভাণ্ডার। কাজেই 'ওটা দিতে হবে' অর্থাৎ ওটা হাতের মুঠোয় আনতে হবে। তাই সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার নামে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ, যেমনটি ইরাকে করা হয়েছিল বুশের আমলে। সেখানে অবশ্য গণ-আন্দোলন ছিল না।
তাই লেবার পার্টির নেতা টনি ব্লেয়ারের পরামর্শ ও সমর্থনে মিথ্যা অভিযোগ আনতে হয়েছিল সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ মানববিধ্বংসী অস্ত্র মজুদের। জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে ইরাক আক্রমণ। সাদ্দাম সপরিবারে নিহত, সেখানে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু উলি্লখিত অস্ত্রের সন্ধান মেলেনি।
আর প্রেসিডেন্ট ওবামা পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে এই সেদিন ঘোষণা করেন, ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য পুরোপুরি সরিয়ে আনা হবে না। আর এ কথা শুনে ইরাকের প্রভাবশালী শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদরের হুমকি, 'ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা না হলে তাঁর সমর্থকরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলবে।' আট বছর হয়ে গেছে ইরাকে শান্তি ফেরেনি। কবে ফিরবে কেউ জানে না।
কিন্তু লিবিয়া দখল যতটা সহজ মনে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের, ততটা সহজ যে নয় তা ক্রমেই বুঝতে পারছে মার্কিন সামরিক প্রশাসন। তাই সামরিক হামলার পাশাপাশি শুরু করা হচ্ছে নতুন কৌশল। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা ও প্রতিরোধ যুদ্ধের তালিম দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কয়েক মাস আগে মার্কিন উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের একটি প্রশিক্ষণ শুরু হয়, তাতে মধ্যপ্রাচ্যের সরকারবিরোধীরা যোগ দেয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে যায়।
আসলে এবার শুধু ইরাক নয়, ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি যুদ্ধবাজদের নজর পড়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। সৌদি আরব, কুয়েত, আবুধাবি প্রভৃতি দেশ তো তাদের অনুগত। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশ, বিশেষত মার্কিনবিরোধী দেশগুলোয় আধিপত্য নিশ্চিত করতে পারলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ হাতে এসে যাবে। যে অর্থনৈতিক মন্দা সম্প্রতি তাদের তাড়িয়ে ফিরছে, তার অনেকটাই সমাধান মিলবে। এবার সিরিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছে ওয়াশিংটন। সিরিয়ায়ও যথারীতি অসন্তোষ, জনবিক্ষোভ। এক পার্টির একতান্ত্রিক শাসনে যেটা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে তা যদি জণকল্যাণের শাসন না হয়। সমাজবাদী বাথ পার্টির কাছ থেকে এমনটা অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরব নেতাদের ধরন-ধারণই আলাদা। হোক তা গণতন্ত্রী বা সমাজবাদী শাসন।
এদিক থেকে সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেননি। দিচ্ছেন না তাঁর পুত্র বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশারও। এমনকি বিক্ষোভ অবসানে তিনিও শক্তির আশ্রয় নিচ্ছেন।
এ সুযোগ ছাড়বে কেন যুক্তরাষ্ট্র? ক্ষেত্র তৈরি শুরু করতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। সম্প্রতি ওবামা বলেছেন, 'কয়েক সপ্তাহ ধরে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর সরকারের ঘৃণ্য আক্রমণের কঠোর নিন্দা জানাচ্ছি আমি।' এরপর সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য সুযোগের অপেক্ষা।
এ বক্তৃতার তাৎপর্য অত্যন্ত স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন, সিরিয়ার রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটা লিবিয়ার মতোই অর্থাৎ এরা মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিনবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত। কাজেই এদের শায়েস্তা করতে পারলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির আওতায় এসে যাবে। এ সত্য বাশারের না জানার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শক্তি রাষ্ট্র পরিচালকদের অন্ধ করে দেয়, যেমনটা দিয়েছিল বাথ সমাজতান্ত্রিক পার্টির একচ্ছত্র নেতা একনায়ক সাদ্দাম হোসেনকে।
সবশেষে একটা প্রশ্ন_উলি্লখিত দেশগুলোয় হঠাৎ করে আসা এ গণবিক্ষোভ কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, কতটা সিআইএ প্ররোচিত? গণ-অসন্তোষ ওইসব দেশে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু তাকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে গণতন্ত্রের নামে কাজে লাগানো হলে তা কতটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ ইতিহাস তেমন সাক্ষ্যই দেয়। সাম্রাজ্যবাদীরা বরাবরই এসবে একজোট, এবারও তাই। তবু ভালো যে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া বলছে, লিবিয়ায় আক্রমণ চালানোর অধিকার ন্যাটোর নেই, চীনও তাই বলছে।
কয়েক দশক আগে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মার্কিন করপোরেট পুঁজি ও বাণিজ্যশক্তি পুনরুদ্ধারের ইতিহাস অনেকেরই জানা। সে সময় এমন ষড়যন্ত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষী চে গুয়েভারা। গুয়াতেমালায় তো তাঁর চোখের সামনেই বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটাল সিআইয়ের ষড়যন্ত্র। ক্ষমতা ছেড়ে মেঙ্েিকাতে আশ্রয় নিতে হলো প্রেসিডেন্টকে। ভূমি সংস্কারের সব কর্মসূচি বাতিল। বলিভিয়া, চিলি প্রভৃতি দেশে নির্বাচিত সরকার বা বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটিয়েছে সিআইএ। সেখানে বসিয়েছে তাদের পছন্দমতো সরকার। স্বার্থরক্ষা হয়েছে যথারীতি।
মধ্যপ্রাচ্যেও এ ধরনের দখলদারির ঘটনাই ঘটতে চলেছে। দখল নিশ্চিত করতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দরকার হয় উপলক্ষের, সেটা যত ছোটই হোক তাতে কিছু আসে-যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের স্থির রাজনীতিতে এই যে অশান্তির ঢেউ এর পেছনে পরাশক্তির ষড়যন্ত্র ও ইন্ধন থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্তত সিআইএর রাজনৈতিক ইতিহাস এর পক্ষেই কথা বলবে। ভবিষ্যতে হয়তো এসব তথ্য অবমুক্ত হয়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হবে। ভবিষ্যৎ সময় সেদিনটার অপেক্ষায় রয়েছে।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.