ধর্ম-রোজার সাধনা ধৈর্য ও সহনশীলতা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজান সবর বা ধৈর্য ধারণের মাস। মানুষের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, কাজকর্মে ও চলাফেরায় ধৈর্য ধারণের মাধ্যমেই সিয়াম সাধনা পরিপূর্ণ হয়। রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য ধারণ করে সকল প্রকার পাপ কাজ, পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকেন।


এটি সমবেদনা প্রকাশের মাস। এ মাসে মুমিন বান্দাদের রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের কঠোর ত্যাগ, উদারতা, সততা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ মাসটি ধৈর্য অবলম্বনের মাস। ধৈর্য ধারণের বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে অতুলনীয় শান্তির আবাস বেহেশত। তাই এ মহান মাসটির পরিচয় তুলে ধরে ধৈর্য ও সবরের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এটা সবর বা ধৈর্যের মাস, আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত)
মাহে রমজান ধৈর্যের মাস। সারা দিন পানাহার বর্জন করে রোজা রাখতে কষ্ট হবেই, বিশেষত, গরমের দিনে সেই কষ্ট আরও অধিক অনুভূত হয়। আল্লাহ তাআলার অগাধ ভালোবাসা ও সওয়াব লাভের অবারিত আশায় অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সেই কষ্ট সহ্য করতে হয়। মসজিদে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে খতমে তারাবি নামাজ আদায় করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ধৈর্যের প্রয়োজন রয়েছে। হাফেজ সাহেব ধীরস্থিরভাবে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করলে একটু অধিক সময় লাগে এবং দণ্ডায়মান থাকতে বেশি কষ্ট হয়। কিন্তু সওয়াবের আশায় এ কষ্টও রোজাদারদের সহ্য করতে হয়। বস্তুত কষ্টের অনুপাতেই সওয়াব নির্ণীত হয়। দীনের কাজে কষ্ট যত বেশি হবে, সওয়াবও তত বেশি হবে। এ মাসে জীবনের সর্বক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান পালনসহ ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। অনেকের মেজাজ কড়া থাকায় ধৈর্যচ্যুত হয়ে সামান্য কারণেই অন্যের সঙ্গে বাদানুবাদ ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। এটা সম্পূর্ণ অনুচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রোজার দিনে কেউ যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল না করে। তার সঙ্গে কেউ ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে সে যেন (অধৈর্য না হয়ে) বলে, আমি রোজাদার।’ (বুখারি)
আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রেও ধৈর্যের প্রয়োজন রয়েছে। রমজান মাসে যারা ধৈর্যের সঙ্গে আল্লাহর কাছে সাহায্য চান, মহান আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন। সিয়াম বা রোজা ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ত্যাগের মাধ্যমে ধৈর্য ধারণের অভ্যাস গড়তে শেখায়। এ মাস মানুষকে ধৈর্যশীল হওয়া ও সংযমবোধ শেখায়। সংযম ছাড়া মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। আসলে মুসলমানরা এ মাসের ধর্মীয় নিয়ম-রীতি পালনের মাধ্যমে যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য ও সহনশীলতার গুণাবলি অর্জন করেন, তা বছরের বাকি ১১ মাস ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সৃজনশীল নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে থাকেন এবং এ মহান ব্রত নিয়েই রোজার আবির্ভাব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে (আল্লাহর কাছে) সাহায্য চাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৫৩)
ঈমান ও সৎকর্ম চালু রাখা এবং সত্য-ন্যায়ের সংরক্ষণ ব্যক্তি ও সমাজের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। এ কঠিন কাজ সম্পাদনের জন্য যে ধৈর্য ও সহনশীলতা বা সবরের প্রয়োজন, তা মাহে রমজানের দীর্ঘ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। আর এ সবর জান্নাতের পথ সুগম করে। যারা মাহে রমজানে সবর করেন, আল্লাহ তাআলা তাদের বেহেশত দান করবেন। হাদিস শরিফে রোজাকে ‘শরীরে জাকাত’ আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে ‘রোজা ধৈর্যের অর্ধেক এবং ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ধৈর্য জান্নাতের ভান্ডারসমূহের একটি ভান্ডার।’
মাহে রমজানে কঠোরভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধৈর্য ও সহনশীলতার যে মানবিক গুণটি অর্জিত হয়, তা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের গুণই নয় বরং এ মহৎ গুণটি কারও মধ্যে সৃষ্টি হলে ঈমানদারের সমষ্টিগত জীবনে অপরের জন্য তা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, মানুষকে কঠিন ও দুর্গম পথপরিক্রমায় চলতে শক্তি জোগায়। রোজা পালনের মাধ্যমে অর্জিত ধৈর্য ও সহনশীলতা ঈমান ও তার ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সাধনায় প্রচুর নিয়ামক শক্তি সঞ্চার করে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত সহনশীলতা তাই শুধু ব্যক্তিগত কল্যাণই বয়ে আনে না, বরং মুসলমান সমাজের জন্য একটি দলগত কল্যাণ বয়ে আনে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই ধৈর্যশীলদের তাদের (ধৈর্যের) প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হবে।’ (সূরা আল-জুুমার, আয়াত-১০)
সুতরাং রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারের মধ্যে যে ধৈর্য ও সহনশীলতা তথা সবরের গুণাবলি সৃষ্টি হয়—ধর্মপ্রাণ মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সুখ-দুঃখে, বালা-মুসিবতে ও অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুরূপ ধৈর্য ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। মাহে রমজান প্রকৃত অর্থেই যেন মানুষের মনের পশুত্ব, আত্মঅহমিকা, হিংস্রতাসহ সব অমানবিক দোষ-ত্রুটি জ্বালিয়ে ভস্ম করে ও ধৈর্য-সহনশীলতা বিকশিত করে। প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা-হূদ্যতা সব মানবিক গুণ অর্জন করে আমরা যেন মুত্তাকি হয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে জীবনের সর্বস্তরে পরিমিতিবোধ, ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারি, আল্লাহ পাক সবাইকে এ তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.