মোবারকের বিচার-ইতিহাসের অমোঘ বিধান

হোসনি মোবারক তিন দশক ছিলেন আরব বিশ্বের জনবহুল গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিসরের ভাগ্যবিধাতা। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বারবার নির্বাচিত হয়েছেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। দেশের অভ্যন্তরে তার কথাই চূড়ান্ত ছিল। আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণেও তার মতামত পেত অশেষ গুরুত্ব।
বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রের তিনি ছিলেন পরম সুহৃদ। ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকান, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক তার সঙ্গে বল্পুব্দত্বকে চোখের মণি হিসেবে সযত্নে রক্ষা করত। কিন্তু মাত্র মাস ছয়েক আগে প্রবল গণবিক্ষোভে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। তাহরির স্কয়ারে টানা ১৮ দিন লাখ লাখ জনতা সমবেত হয়ে জানিয়ে দিয়েছিল, অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছে মিসরবাসী। এখন বিদায় হোন। তিনি সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এক পুত্রকে উত্তরাধিকার করার বাসনাও অপূর্ণ রয়েছে। এখন তিনি রাজধানী কায়রোতে হত্যা ও দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন। বুধবার রাজধানী কায়রোর পুলিশ একাডেমীতে অস্থায়ী আদালতে তাকে যখন কাঠগড়ায় তোলা হয়, তখন বাইরে সমবেত হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ সমবেত কণ্ঠে দাবি তোলে ফাঁসির দণ্ড প্রদানের। একই আদালতে মোবারকের দুই পুত্র এবং কয়েকজন সহযোগীর বিচারও শুরু হয়েছে। এ যেন ইতিহাসের অমোঘ বিধান। হোসনি মোবারক শুধু নন, মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক দেশের শাসকরা নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছেন। বিরোধী মতকে বিন্দুমাত্র স্থান ছেড়ে দিতে তারা রাজি ছিলেন না। জনগণ যে জেগে উঠতে পারে, সেটা তারা আমলে নিতে চাননি। গণতন্ত্রকে যে পথ করে দিতে হয়, সেটা মানতে ইচ্ছা হয়নি আদৌ। তার এ পরিণতি দেখে লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোর শাসকরা শিক্ষা নেবেন, এটা প্রত্যাশিত। লিবিয়ায় অস্থিরতার সুযোগে বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে। সিরিয়ায় পাঁচ মাস ধরে চলা গণআন্দোলন দমনে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ নিষ্ঠুর দমননীতির পথ অনুসরণ করছেন। এসব দেশের শাসকদের বুঝতে হবে যে এই জমানায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা অদম্য এবং শক্তিবলে কেউ তা ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। এমন চেষ্টা করা হলে কেবল রক্তক্ষয়ই হয় না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও দারুণভাবে ব্যাহত হয়। হোসনি মোবারক যদি গণদাবির কাছে নতিস্বীকার করে দ্রুত ক্ষমতা ছেড়ে দিতেন তাহলে হয়তো বিবর্ণ চেহারায়, অসহায় অবস্থায় আসামির কাঠগড়ায় স্ট্রেচারে শুয়ে থাকতে হতো না। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত এবং তার বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ এক বাক্যে নাকচ করে দিয়েছেন। কিন্তু জনগণের সহানুভূতি মিলছে না। তিন দশক একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগের কারণে তার একদল সমর্থক থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের কণ্ঠ ক্ষীণ এবং ইতিহাসের চাকা বিপরীতমুখী করার ক্ষমতা তাদেরও বোধ করি নেই। বিচার কাজ শুধু প্রকাশ্যেই চলছে না, তা দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনেও। শুধু মিসর নয়, আরব বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে এ বিচারের দৃশ্য অবলোকন করছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। অন্যান্য দেশের স্বৈরশাসকরাও হোসনি মোবারকের করুণ পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। তাদের বুঝতে হবে, জনগণ কোনো দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হলে তা রোখার ক্ষমতা কারও নেই। সব দেশে সব কালের জন্যই এটা চরম সত্য।

No comments

Powered by Blogger.