সপ্তাহের হালচাল-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন রূপরেখা by আব্দুল কাইয়ুম

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে হুবহু একইভাবে ঘটে না। এখন আওয়ামী লীগ চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নামক একটি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আর বিএনপি চায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ অবস্থায় যদি ইতিহাসের হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন


করতে হবে। এরপর কী হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিদায় তো নিতে হবেই, উপরন্তু দল ও নেতৃত্বের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষমতাসীন সরকার যদি সেই বেদনাদায়ক পরিণতি না চায়, তাহলে আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি সমঝোতায় আসতে হবে।
এ জন্য দুই নেত্রীর শীর্ষ বৈঠকের দরকার নেই। যেটা গত ২২ বছরে একবারও হয়নি, সেটা আর হবেও না। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহানসহ বিশিষ্টজনের জি-৫ গ্রুপের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানও এসেছিলেন বাংলাদেশে। কোনো ওষুধেই কাজ হয়নি। সংঘাতের পথেই বাংলাদেশের রাজনীতি এগিয়ে গেছে। আজও সেই ধারা চলছে। এতে গণতন্ত্রের অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে, তবে সৌভাগ্যক্রমে টিকে আছে। একটা সংসদ আছে, যদিও বিরোধী দল সেখানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে না। নির্বাচন হয়। অবশ্য সেইসব নির্বাচনকে সবাই ভালো বললেও পরাজিত দল বলে ‘কারচুপির নির্বাচন’। এইভাবে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র এগিয়ে চলেছে।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কৌতুক শুনেছিলাম। এক রোগী চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। দেখা গেল কলেরা, টাইফয়েড থেকে শুরু করে হাঁপানি—কোনো রোগই তাঁকে কাবু করতে পারেনি। এ অবস্থায় চিকিৎসক তাঁর পিঠে একটা ত্রিশূল বাঁধার ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বললেন, একমাত্র বজ্রাঘাত ছাড়া ওই রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। এখন বাংলাদেশের জন্য ওই ধরনের একটা রাজনৈতিক ত্রিশূল খুঁজে বের করতে হবে।
এ জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণসমৃদ্ধ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যদি পাঁচ বছর পরপর এ ধরনের নির্বাচন করা যায়, যদি নির্বাচন কমিশন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে রাজনীতিতে অস্থিরতা থাকলেও, যেটা না থাকলেই ভালো, কিন্তু যদি থাকেও, অন্তত গণতন্ত্র টিকে থাকবে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।
কয়েক দিন আগে এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কাছে যাই। তিনিও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করলেন। ১৯৯৫-১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে তাঁদের ভূমিকা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর তিনটি লেখার একটি সংকলন তিনি আমাকে দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখো, অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগবে।’
ওই সময় খালেদা জিয়া ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা। খালেদা জিয়ার দাবি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের হতে হবে নির্বাচিত অর্থাৎ তাঁরা হবেন দলীয়। শেখ হাসিনার মূল দাবি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে নির্দলীয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দুই পক্ষ বেশ কাছাকাছি আসে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনের চার সপ্তাহ আগে পদত্যাগ এবং বিরোধী দলের পাঁচজন ও সরকারি দলের ছয়জন নির্বাচিত সাংসদকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে রাজি ছিলেন। কিন্তু দলীয় সাংসদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে শেখ হাসিনা রাজি ছিলেন না। আরও অনেক মতভেদ ছিল। শেষ পর্যন্ত দুই নেত্রীর এক টেবিলে বসা সম্ভব হয়নি। তারপর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। আমরা সেসব জানি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি হয়, তাহলে সেখানে আওয়ামী লীগের সমর্থিত সদস্য বেশি হবে, নাকি বিএনপির সমর্থিত সদস্য বেশি, নাকি সমান? সেই প্রশ্ন কিন্তু এখনো থেকেই যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বলবে, সংসদে তাদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্য, তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তাদেরই প্রাধান্য থাকতে হবে। বিএনপি এতে রাজি হবে না। এই সংখ্যার দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো অসুখ।
বিগত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় এরশাদ হটাও আন্দোলনের একপর্যায়ে এ ধরনের সমস্যা উপস্থিত হয়। তখন অভাবনীয় কৌশল গ্রহণের একটি প্রস্তাব এসেছিল। এরশাদকে যেহেতু রাজপথের আন্দোলনে সরানো যাচ্ছিল না, তাই সবাই মিলে ঠিক করলেন যে নির্বাচনের মাধ্যমেই এরশাদের পতন ঘটানো হবে। কীভাবে? খুব সহজ। বিরোধী দলের প্রার্থী থাকবেন মাত্র দুজন—হাসিনা ও খালেদা। তাঁরাই ভাগাভাগি করে ৩০০ আসনে দাঁড়াবেন। এতে বিপুলসংখ্যক আসনে হাসিনা-খালেদার জেতার সম্ভাবনা ছিল। বিজয়ের পর তাঁরা নিয়ম অনুযায়ী একটি করে আসন রেখে অন্য আসনগুলোতে পদত্যাগ করবেন এবং উপনির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসবেন তাঁদের দলীয় প্রার্থীরা। ওই সময় যেকোনো প্রার্থী যত খুশি আসনে দাঁড়াতে পারতেন। এই প্রস্তাবটি ‘সিপিবি’ ফর্মুলা নামে তখন পরিচিতি পায়।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, কে কয়টা আসনে দাঁড়াবেন। সিপিবির প্রস্তাব ছিল ১৫০-১৫০। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাতে রাজি ছিল না। তারা বলল, তাদের শক্তি বেশি, তাই তাদের বেশি আসন দিতে হবে। শেখ হাসিনা ১৮০, খালেদা জিয়া ১২০ আসনে দাঁড়াবেন। এইভাবে কথা চালাচালি হচ্ছিল। এই ফাঁকে এরশাদ নতুন আইন করলেন—এক ব্যক্তি পাঁচটির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। ওই ফর্মুলার সেখানেই ইতি।
অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে মনে হয় আমাদের ফিরে যেতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দিকেই। অবশ্য হুবহু আগের মতো হবে না। একে আওয়ামী লীগ যদি বলতে চায় ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার, বিএনপির তা মেনে নেওয়া উচিত। কারণ, তারা অতীতে নির্বাচিতদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছিল। সুতরাং একটা আলোচনা শুরু হতে পারে। নির্বাচিতদের নিয়ে নির্বাচনকালীন একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হোক। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও এ রকম একটা সুযোগ রাখা হয়েছে। সংসদ আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে—এ মর্মে আইন করা যেতে পারে। সংবিধান সংশোধন না করলেও সম্ভবত চলবে, যদি সব দল রাজি থাকে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কোন দলের কতজন প্রতিনিধি থাকবে? আরেকটি সমস্যা হলো সেই প্রতিনিধিদের কে নির্বাচন করবে? দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্বাচিত করা হবে, নাকি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অপেক্ষাকৃত সুবিবেচনাপ্রসূতদের রাখা হবে।
এ ব্যাপারে ড. আকবর আলি খান একটি চমকপ্রদ প্রস্তাব দিয়েছেন। টেলিভিশনে একটি আলোচনায় তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের পাঁচজন সাংসদ নির্বাচিত করবে বিএনপি আর বিএনপির পাঁচজন সাংসদ নির্বাচিত করবে আওয়ামী লীগ। তাহলে হয়তো অপেক্ষাকৃত সচেতন ও দায়িত্বশীল একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার পাওয়া যেতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে দেবে বিএনপি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সাংসদদের মধ্য থেকে, যিনি ওই পাঁচজনের মধ্যেই থাকবেন। তাহলে আর সংবিধান সংশোধনীর প্রয়োজন পড়বে না। ড. আকবর আলি খান মনে করেন, যদি সংবিধান সংশোধনী ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যেতে হয়, তাহলে এটা ভালো সমাধান হতে পারে। একই সঙ্গে ড. আকবর আলি খানের প্রস্তাব হলো, যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্য হবেন, তাঁরা নির্বাচন করবেন না।
এই প্রস্তাব বেশ চমকপ্রদ। অবশ্য প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের নির্বাচন না করতে পারার ব্যাপারটি সাংসদদের মেনে নেওয়া কঠিন হতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের পর কোনো শূন্য আসনে উপনির্বাচনের সুযোগ তো তাঁদের থাকছেই। এখন প্রশ্ন হলো, সংখ্যাসাম্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মেনে নেবে কি?
এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠতে পারে। আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী বাছাই করতে বিএনপির আপত্তি থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী, যে নামেই ডাকা হোক, তিনি সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ব্যক্তিও হতে পারেন। এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। দক্ষ কিন্তু দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি আমাদের সমাজে এখনো অনেকে আছেন। তবে সে রকম কাউকে নিতে হলে তাঁকে আবার বিশেষ ব্যবস্থায় নির্দলীয় সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এত আগে এসব আলোচনার দরকার কী? নির্বাচনের দু-তিন মাস আগে ওসব নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু এ ধরনের মনোভাব সুফল দেবে না। সমস্যাটা জটিল। যদি নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে আলোচনা এখনই শুরু করতে হবে।
সমঝোতা ছাড়া এককভাবে এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব দেশের জন্য ভালো কিছু এনে দেবে না। একরোখা মনোভাবের কারণে সাম্প্রতিক অতীতে দেশে বারবার রাজনৈতিক দুর্যোগ হানা দিয়েছে। এক এক সময় মনে হয়েছে, সব বুঝি গেল। অনেকে বলতেন এবং এখনো বলেন, বাংলাদেশের কপালে দুঃখ আছে, গণতন্ত্র বুঝি আর থাকে না। ‘ভঙ্গুর রাষ্ট্রের’ কথাও শোনা গেছে বিভিন্ন সময়। যাক, অনেক কঠিন পরীক্ষায় বাংলাদেশ উতরে গেছে। এ দেশে সবই হয়। এক-এগারোও হয়। আবার ভবিষ্যতে সংবিধানবহির্ভূত কোনো সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ ‘বেআইনি’ করে সংসদে আইনও হয়। এখন সামনের দিকে তাকিয়ে একটা মসৃণ গণতন্ত্রের কথা ভাবতে হবে।
রাজনীতিতে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আগেই একটা সমঝোতা হোক।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.