সবচেয়ে ভালোবাসো মাতৃভাষাকে by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ক্লাসঘরের কথা দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি অপ্রয়োজনের জিনিস দেখতে সুন্দর হয়। দরকারি জিনিস হয় কদাকার আর স্থূল। যেমন ধর, মালবাহী ট্রেন বা ট্রাক। কত দরকার ওদের। না হলে দেশের পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অথচ দেখতে কী বদখত। যেন একেকটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তু।


কিংবা ধর, শ্যামবাজার বা মৌলভীবাজারের মতো জায়গা_গোটা শহরের চাল-নুন-তেলের জোগান আসছে সেসব থেকে। বন্ধ করে দাও না ওগুলো দিন দশেকের জন্যে, দেখবে ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ থেকে ২০ লাখে নেমে এসেছে। অথচ কী কুৎসিত জায়গাগুলো। কী ব্যস্ততা, কী গরম, গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি! সৌন্দর্যের প্রধান শর্তই তাই 'অপ্রয়োজনীয়তা'। তাকিয়ে দেখ না মোনালিসা বা তাজমহলের দিকে। কোনো দরকারে লাগে এগুলো? খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, এমনকি দারিদ্র্য দূরীকরণ_এসব ব্যাপারে কোনো কাজে আসে? কিংবা পৃথিবীজোড়া যে হাজার হাজার মনোরম উদ্যান, লাখ লাখ অলৌকিক চিত্রকর্ম, সৌকর্যময় নাচঘর, মানুষের গাওয়া অবিশ্বাস্য অনুপম সংগীত, অবিস্মরণীয় গল্প, নাটক, উপাখ্যান, কাব্য, মহাকাব্য, রবীন্দ্রনাথ বা বেটোফেনের সুর_এক কথায় মানবজাতির যা কিছু অনন্য_কোনো বাস্তব দরকারে আসে এরা? কিংবা মেয়েদের আরেকটু রূপসী বা মোহময় করার জন্যে অলঙ্কার, সাজসজ্জা আর পোশাক-আশাকের যে রঙিন-বর্ণিল অন্তহীন জগৎ কিংবা নৃত্যকলা, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য_যা দিয়ে মানুষ নিজেকে বা জগৎকে সুন্দর আর লাবণ্যমধুর করেছে_কী জাগতিক প্রয়োজন মেটায় তারা? কেন মোহাম্মদ আলী বঙ্ংিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলেন? পাড়ার মাস্তানদের সঙ্গে মারামারি করার জন্য? কেন মেসি বা ম্যারাডোনা ফুটবলের জাদুতে মানুষকে হতবাক করতে চান, এ কি কেবল অর্থের জন্য? না। আরো অনেক বড় প্রয়োজনে_স্বপ্নের জন্য, গৌরবের জন্য। দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি বইতে আমরা সান্তিয়াগোকেও দেখছি : তেমন কোনো বাস্তব দরকারে নয়, শুধু একটা মাছ শিকারের গৌরবের জন্য_একজন জেলের জীবনের যা সর্বোচ্চ স্বপ্ন ও অহঙ্কার_পৃথিবীর সুন্দরতম, বৃহত্তম একটি মাছ শিকার_তার জন্য কী দুঃসাধ্যের পথে সে পাড়ি জমিয়েছে।
চিন্তা করে দেখ, এক দিন, দুই দিন নয়; নিঃসঙ্গ বিশাল সমুদ্রের মধ্যে দীর্ঘ ৮৪টা দিন_একা একা_পানি নেই, খাবার নেই, সমুদ্রের কাঁচা মাছ খেয়ে জীবন বাঁচিয়ে তার আরাধ্যের দিকে সে এগিয়ে গেছে_এমন শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ নিয়ে কয়দিন টিকে থাকা যায়? কিন্তু সে অপরাজিত, নাছোড়বান্দা। জীবনের শ্রেষ্ঠ মাছটির দেখা পাওয়া তার চাই-ই চাই। মাছটির আগে অনেক ছোট ছোট মাছ ধরা পড়েছে তার হাতে। কিন্তু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সে সেগুলোকে ফেলে দিয়েছে। তার স্বপ্ন ছোটর জন্য নয়, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতমের জন্য। তার চোখ যদি সামান্যকে চাইত, এই নির্দয়-নিষ্ঠুর-কষ্টের মুখে পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই কোনো তুচ্ছ মাছ নিয়ে সে বন্দরে ফিরে আসত। কিন্তু সে কোনো সাধারণ জেলে নয়; সাধারণ হলে এ গল্প তাকে নিয়ে লেখাও হতো না। আগেই বলেছি, শুধু তেল-নুন-লাকড়ির জন্য সে যায়নি। তার স্বপ্ন মহত্ত্ব-প্রাণিত। ছোট কিছু নিয়ে জীবনের গৌরবকে সে অমর্যাদা করতে নারাজ। তার ঈপ্সিতকে সে শেষ পর্যন্ত পায়নি। যেমন শূন্য হাতে সে গিয়েছিল তেমন শূন্য হাতে সে ফিরে এসেছে। কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে গৌরবের এক বীরোচিত ইতিহাস। এই বইয়ের মধ্যে যে গল্প আমরা পাই, তা মহান মানুষদের গল্প। হতে পারে লোকটা সামান্য জেলে, হতে পারে তার সংগ্রাম একটা সামান্য সামুদ্রিক মাছের জন্য, কিন্তু স্বপ্নে-সংগ্রামে-সাহসে-শক্তিতে সে মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানুষদের সারিতে। অল্প দামে মানবিক অস্তিত্বকে বিক্রি করে সে তাকে অসম্মান করেনি।


মানুষের ইচ্ছাশক্তি কি সচেতন না অচেতন? আমার মনে হয় এ সচেতন। রক্তের জ্বলিত প্রেরণায় এ অস্বস্ত, মুখর। আমাদের দেশে এই চৈতন্যের মর্মান্তিক দুরবস্থা। তোমরা দেখেছ আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে বক্তৃতা হয়। বক্তৃতা যখন শেষ হয়, তখন ঘোষক তার ঘোষণায় বলে এতক্ষণ আপনারা বক্তৃতা-পর্ব শুনলেন, এখন শুরু হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যেন অনুষ্ঠানের বক্তৃতা-অংশটা সংস্কৃতি ছিল না। যেন অনুভূতির, বিনোদনের, গান-নাচের উচ্ছল আতশবাজিটুকুই শুধু সংস্কৃতি। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। আমাদের দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি সম্পর্কে, জীবনের উচ্চতর বোধ সম্পর্কে, ইচ্ছাশক্তির ঊর্ধ্বতন সম্পর্কে মানুষের ধারণা আজও অস্পষ্ট। আমরাও তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।
সান্তিয়াগোর মধ্যে আমরা চৈতন্যের এই অবিচল-অপরাজিত স্বপ্ন আর ইচ্ছাশক্তির দুঃসাহসী বোধ দেখতে পাই। এ শক্তি তরুণ বয়সের মতো উচ্ছল ও অপচয়ী নয়_সুসংহত, ভারসাম্যপূর্ণ ও সুদৃঢ়। তারুণ্য অল্পবয়সের সম্পত্তি, তাই তা তীব্র, অন্ধ, দুর্বার। একজন বৃদ্ধের যৌবন আর একজন যুবকের যৌবনের মধ্যে পার্থক্য তাই আকাশ-পাতাল। একজন বৃদ্ধের যৌবন হচ্ছে তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতার যোগফল, যা যৌবনের রক্তিম আগুনে লেলিহান। তা পোড়-খাওয়া, অভিজ্ঞ, পরিণত। তার সামনে একজন যুবক কী করে দাঁড়াতে পারে? ওই যে প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সেকালের সব লেখক একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছিল_শেষের কবিতার নিবারণ চক্রবর্তী অ্যান্ড গং। অবশ্য নিবারণ চক্রবর্তী একটা প্রতীকী নাম। এ আসলে সেকালের তরুণ লেখকরা। বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমাররা। সবাই বিদ্রোহে নেমেছিলেন রবীন্দ্রযুগের অবসান ঘটাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত 'শেষের কবিতা'র মতো সবচেয়ে যৌবন-মঞ্জরিত, সবচেয়ে আধুনিক ও রক্তিম বইটি লিখলেন কে? ওই তরুণরা, না ওই বৃদ্ধ? যৌবন বার্ধক্যের সম্পত্তি নয়, কিন্তু কোনো বৃদ্ধের মধ্যে সত্যি যদি যৌবন বেঁচে থাকে তবে তার চেয়ে দুর্ধর্ষ আর কিছু নেই। সান্তিয়াগোর মধ্যে আছে এ অদমিত যৌবন। তাই সে মন আদিম দুর্বার অপরাজিত, অথচ আত্মস্থ। সান্তিয়াগো কেবল যুদ্ধপ্রবীণ নয়, সে বহুদর্শী, বিনীত ও সহনশীল। অথচ এর পাশাপাশি সে এমন এক বৃদ্ধ, যে তন্দ্রার ঘোরে পরাক্রান্ত যুবকদের মতোই আফ্রিকার সিংহের স্বপ্ন দেখে।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.