নৈরাজ্য-গণপিটুনি রুখে দাঁড়াও by মোহীত উল আলম

মৃত্যুর একটাই রূপ হলেও এর নানা ধরন আছে। যে কেউ একটা ইঁদুরকে মেরে ফেলতে পারে একটা লাঠির ঘায়ে, সেটা মানুষ সহ্য করে নেবে। কিন্তু একটা ইঁদুরকে ঘরের চালায় ঝুলিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারলে সেটি হবে নিষ্ঠুরতা, বীভৎসতা।


মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনকেন্দ্র খুলেছিল। সেখানে তারা নিরপরাধ বাঙালিদের বন্দী করে এনে তারপর নানা কায়দায় নির্যাতন করে মেরে ফেলত। এই নির্যাতনের কাহিনির কথা যত জানা যাচ্ছে, তত আমরা শিউরে উঠছি পাকিস্তানি সেনাদের বীভৎসতায়। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের উগ্র বর্ণবাদী সংস্থা কু ক্লাক্স ক্ল্যান দলের নিগ্রো বা কৃষ্ণকায় লোক হত্যা বা হিটলারের গ্যাস চেম্বারে ইহুদি নিধন বা বাংলা ভাইয়ের জেএমবির গাছের ডালে মানুষ ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হলো নিষ্ঠুর মৃত্যুর উদাহরণ।
বীভৎস নারকীয় হত্যালীলা যুগে যুগে সব সমাজে সব অবস্থায় ঘটে থাকে। বাংলাদেশেও ঘটছে। এখন যেটার হিড়িক পড়েছে, সেটা হচ্ছে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা। কিছুদিন আগে আমিনবাজারের ট্রাক টার্মিনালের পেছনে তুরাগ নদের চরে শবে বরাতের রাতে দারুস সালাম এলাকার ছয়জন ছাত্র-যুবককে এলাকাবাসী ডাকাত সন্দেহে নির্মমভাবে খুন করে। আর গত ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে মিলন নামের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। এই পিটুনির একটি ভিডিওচিত্র ৭ আগস্ট রোববার ‘সময়’ চ্যানেলে দেখানো হয়। যাঁরা এটি দেখেছেন, তাঁরা হয়তো কল্পনা করতে পারেননি, মানুষ এত নির্মম হতে পারে। ফুটবলকে যেভাবে লাথি মারে, সেভাবে ছেলেটাকে জনতা লাথি মারছিল। তার শরীরটা ফুটবলের মতো এদিক থেকে সেদিক ছিটকে যাচ্ছিল। একটি লাথি তার গোপনাঙ্গের জায়গায় পড়তে দেখলাম। যখন মার সহ্য করতে না পেরে ছেলেটি মাটিতে শুয়ে পড়ল, তখন চলল পদাঘাত। ওহ, সে কী নৃশংস দৃশ্য! পরের দিন (৮ আগস্ট) প্রথম আলোর প্রতিবেদনে পড়লাম, ওই একই ভিডিওচিত্রের শেষের দিকে দেখা গিয়েছিল যে একজন সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরা লোক মিলনের মাথা ইট মেরে থেঁতলে দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
কিন্তু মিলনের হত্যাকাণ্ডে খানিকটা বিচিত্রতা আছে। বলা হচ্ছে, প্রথমে গ্রামবাসী ওই থানার এসি আকরাম নামের একজন পুলিশের কাছে ছেলেটিকে ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশের ভ্যানে তুলে দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর পুলিশ নাকি আবার ছেলেটিকে টেকেরমোড়ে জনতার মধ্যে এনে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়, আর জনতাকে বলে ছেলেটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে। ২ আগস্ট মিলনের মা কোহিনূরের দায়ের করা মামলায় আরও জানা যায়, পুলিশের উপস্থিতিতে, পুলিশের উসকানিতেই গ্রামবাসী নাকি এ হত্যালীলা চালায়। পুলিশ কেন আক্রান্তকে জনতার নারকীয় হাত থেকে উদ্ধার করল না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাতের খবরে (৭ আগস্ট) জানিয়েছেন, তিনজন পুলিশকে এ ঘটনায় সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ ঘটনার বিশ্লেষণ করলে সমাজের নানা গোষ্ঠীর নানা অস্থির চেহারা ফুটে ওঠে। এর মধ্যে পুলিশ, জনতা ও সরকার নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক।
প্রথমে বলি পুলিশের দিক: পুলিশের হতাশার কথাটা আমাদের বুঝতে হবে। পুলিশ চোর-ডাকাত ধরে না যে তা নয়। দাগি আসামি ধরার ক্ষেত্রে পুলিশের যথেষ্ট পারদর্শিতা আমরা সময়ে সময়ে লক্ষ করি। কিন্তু পুলিশের চাকরিটা সর্বার্থে একটি ঝুঁকিপূর্ণ চাকরি। তারা আসামি ধরে আদালতে চালান দেয়, সেখানে আইনের ফাঁকফোকরে দাগি আসামিকে বের হয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। পুলিশ অপরাধী ধরে থানায় আনে, তারপর সরকারদলীয় বা এলাকার প্রভাবশালী নেতা, উপনেতা, বড়কর্তা, এমনকি মন্ত্রী পর্যায়ের লোকজনের তদবিরে তাদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে ওঠে। আবার পুলিশের বেতন-ভাতাদি সুবিধাজনক পর্যায়ে নয়। তারা নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে অন্য অনেক সরকারি সংস্থার ব্যক্তিদের মতো। আবার দুর্নীতির রোগটি যেমন চাকরির পরিবেশ থেকে জন্ম নেয়, তেমনি জন্ম নেয় পরিবারের পরিবেশ থেকে। আর বৈজ্ঞানিকভাবে বললে জিনগত বৈশিষ্ট্য থেকে। একটি দেশের জনসংখ্যা বাড়লে যেমন ভালো লোকের সংখ্যা বাড়ে, তেমনি বাড়ে অপরাধীর সংখ্যাও। সম্ভবত ভালো লোকের সংখ্যা বাড়ে গাণিতিক হারে ১, ২, ৩, ৪—এই ধারায়। আর খারাপ লোকের সংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে ২, ৪, ৮, ১৬—এভাবে। এই বর্ধমান অপরাধী জনগোষ্ঠীর তুলনায় পুলিশের লোকবল, যন্ত্রবল, অস্ত্রবল ও সাংগঠনিক দক্ষতা নিতান্তই অপ্রতুল। এতগুলো চাপের মধ্যে থাকলে যা হয় তা-ই হয়েছে, সাধারণভাবে পুলিশের পক্ষে তার নৈতিকবল ঠিক রাখা সম্ভব হয় না।
পুলিশের পক্ষে তখন যে সমস্যাটা তৈরি হয় সেটা হচ্ছে, নিরপরাধী আর অপরাধীর মধ্যে বিভেদ নিশ্চিত করতে না পারা। সাধারণভাবে মানুষের অভিজ্ঞতা বলে যে অপরাধীর চরিত্র চেহারায় ফুটে ওঠে। তবে সমাজের ওপরের শ্রেণীর তেল-চকচকে চেহারার লোকদের মধ্য থেকে অপরাধী চেনা কঠিন। তাই চেহারা দিয়ে চরিত্র বিচার করার পদ্ধতি চালু গৎ হলেও শতভাগ সঠিক নয়। সন্দেহ করা যায় মাত্র, কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায় না। এই নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুলিশকে আদালতের আশ্রয় নিতে হয়। আদালত থেকে নিরপরাধী বের হচ্ছে কি না, সেটা পরের কথা, কিন্তু অপরাধী বের হয়ে আসার একটা রেওয়াজ দেশে তৈরি হয়েছে। এদিকটা পুলিশকে নিতান্তভাবে হতাশাগ্রস্ত করে বলে ধারণা। মিলনকে যে পুলিশ বা পুলিশের দল জনতার রোষের মধ্যে ছেড়ে দিল, তাদের এ ন্যক্কারজনক নৈতিক-দায়িত্ববোধহীনতা শুধু একটা ওপরের ব্যবহারমাত্র, এর পেছনে যে গোষ্ঠীগত হতাশা কাজ করছে না, তা নিশ্চিত বলা যাবে না। পুলিশ হয়তো ভুলভাবে মিলনকে ডাকাত বলে সন্দেহ করেছে, কিন্তু এখানেই কথাটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। কথাটা শেষ হচ্ছে এখানে যে ভুলভাবে সন্দেহ করলেও পুলিশের মনে হয়েছে অপরাধীকে নিয়ে থানা, আদালত, মামলা, প্রতিবেদন, জামিন, মুক্তি—এসব নিয়ে ঝামেলা না করে বরং জনতার হাতে দিয়ে দেওয়া হোক। জনতার আদালতই (?) ঠিক করবে, ছেলেটাকে মেরে ফেলবে, না বাঁচিয়ে রাখবে। অর্থাৎ পুলিশের আচরণের মধ্যে যে নৈরাজ্য লক্ষ করা গেল, সেটার জন্য পুলিশ বাহিনী কোনোক্রমে একা দায়ী নয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুলিশের আচরণের মধ্যে এক ধরনের গভীর অবসাদগ্রস্ততা নিয়ে এসেছে।
জনতার নৃশংস অভিব্যক্তিমূলক আচরণের সঙ্গে পুলিশের অবসাদগ্রস্ততার সূক্ষ্ম সম্পর্ক রয়েছে। আমিনবাজারের হত্যাকাণ্ডের উৎস হচ্ছে ওই এলাকায় এত ডাকাতি হচ্ছিল যে এলাকাবাসী পুলিশকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছিল না। তারা নিজেরাই নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করে পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। ফলে যখন অপরিচিত সাতজন যুবক ওই এলাকায় রাতে নামল, তাদের ধারণা হয়েছিল যে নিশ্চয়ই তারা ডাকাতি করতে এসেছিল। ব্যস, ওইখানেই চরের ওপর গণসংহার সমাপ্ত হলো।
সমাজের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় বেড়ে যায়। তখন সাধুকে চোর মনে হয়। আবার গণপিটুনির ঘটনাগুলো লক্ষ করলে দেখা যাবে যে সাধারণত যারা গণপিটুনিতে অংশ নেয়, তারা নিজেরাই কমবেশি অপরাধপ্রবণ লোক হয়ে থাকে। কারণ, এমন দেখা যায় না যে সচ্চরিত্রের, বোধসম্পন্ন ও অনুকম্পাসম্পন্ন মানুষ এ রকম বারোয়ারি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে। যদি সম্ভব হয় একটা শুমারি করার, তাহলে দেখা যাবে যে গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া লোকগুলোরই নিজেদের কোনো না কোনো সন্ত্রাসী ইতিহাস আছে। আর কিছু লোক আছে, যাদের মধ্যে চাপা হিংস্রতা বিরাজ করে, কিন্তু তারা মারামারিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে না। এদের অনেকেই উসকানিদাতার ভূমিকা পালন করে। ‘মেরে ফেল, মেরে ফেল, পুলিশ বলেছে মেরে ফেলার জন্য, মারিস না কেন?’ এ কথা বলে যারা অন্যদের মিলনের মৃত্যু ঘটাতে উসকানি দিয়েছিল, তারা দেখা যাবে পুলিশ যখন তদন্তে আসবে তখন বলবে ‘তারা কিছু জানত না, তারা গণপিটুনিতে অংশ নেয়নি’ এবং ‘তারা বরং বাধা দিয়েছিল’। গণপিটুনির ঘটনার একটি ‘দুঃখজনক’ সুবিধা হলো যে এর মধ্য থেকে যেকোনো রকমের প্রহেলিকা সৃষ্টি করা যায়। যেমন—মিলন কি আসলে ডাকাত ছিল কি না, ডাকাত না হলে সে ভিন্ন জায়গা থেকে কী কারণে কোম্পানীগঞ্জের স্কুলটিতে গেল, পুলিশই বা অমন করে তাকে জনতার রোষের মধ্যে ঠেলে দিল কেন, কেনই বা লোকগুলো এভাবে নির্মমতার সঙ্গে মিলনকে হত্যা করল, কারাই বা নেতৃত্ব নিয়েছিল পিটুনিতে? ইত্যাকার প্রহেলিকা ভেদ করা তদন্ত কমিটির পক্ষে সম্ভব হয় না।
সরকারের জন্য গণপিটুনি শাঁখের করাত। কারণ, জনতার নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া মানে সরকারের নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর তাদের আস্থাবোধ কমে যাওয়ার প্রকাশ। সরকারের জনপ্রিয়তাও খর্ব হয়। কিন্তু পুলিশ গিয়ে গ্রামের সব লোককে গ্রেপ্তার করলে তখন নিরীহ লোক ধরা পড়ে যায় বলে সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আবার পুলিশকে দায়িত্বে অবহেলার জন্য বরখাস্ত করলে পুলিশ এর প্রতিক্রিয়ায় অতিরিক্ত আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে ফেলে। আরেকটা সমস্যা হলো, গণপিটুনির ধারাটা সংক্রামক। একবার মানুষের মনে যদি এ মনোবৃত্তি উসকে ওঠে এবং রাস্তা খুঁজে পায় যে মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়, তাহলে টেকেরমোড়ের ঘটনাটা শেষ ঘটনা হয়ে থাকবে না। দ্রব্যমূল্য, পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ সরবরাহসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। যেকোনো ছুতায় লোকজন রাস্তায় নেমে আসছে। এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। এর সঙ্গে গণপিটুনি যোগ হলে সরকারের নাভিশ্বাস উঠবে। তাই এ সময়ে গণপিটুনির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্পূর্ণ রাশ ধরার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.