বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-অধিবর্ষের আনন্দ আজ by অরুণ বসু

আজ শেষ দিন। আজ বাজবে বিদায়ের সুর। ভাঙবে লেখক, পাঠক, প্রকাশকের মিলনমেলা। শেষ হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১২। শুধু কি বিদায়, অন্য এক আনন্দও উদ্যাপিত হবে আজ। বছরের স্বল্পায়ু মাস ফেব্রুয়ারি যদি ২৮ দিনেই শেষ হতো, তবে গতকাল মঙ্গলবারই শেষ হয়ে যেত মেলা। অধিবর্ষের (লিপ ইয়ার) কৃপায় এবারের ফেব্রুয়ারি ২৯ দিনে।


আজকের বইমেলা তাই যেন ফুটবল মাঠের উত্তেজনাকর অতিরিক্ত সময়ের খেলা।
এই অতিরিক্ত সময়ের উত্তাপ গতকাল যেন আগেভাগেই ভর করেছিল বইমেলায়। উপচে পড়া ভিড়ে জমজমাট ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। ঘোরাফেরা আর কেনাকাটার মানুষে একাকার। দম ফেলার ফুরসত নেই স্টলকর্মীদের। কানায় কানায় পূর্ণ লেখককুঞ্জে লেখকদের জমাটি আড্ডা। প্রথমা স্টলের সামনে উছলে ওঠা ভিড়ে যারা ভোর এনেছিল বইয়ে দুহাতে নিজের স্বাক্ষর (অটোগ্রাফ) বিলাতে বিলাতে ঘেমে উঠেছেন লেখক-সাংবাদিক আনিসুল হক। বিদ্যাপ্রকাশে পাঠকদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন লেখক মোহিত কামাল।
ওই ঝমঝমানো মেলার মধ্যে কারও কারও কণ্ঠে বেদনার সুর। এক মাকে তাঁর কিশোর ছেলের সকরুণ জিজ্ঞাসা, ‘মেলা কালই শেষ হবে, মা?’ মেলা নিয়ে লেখেন এমন এক তরুণ সাংবাদিক বললেন, ‘মেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগছে, ভাই।’ অর্থাৎ মেলার সানাইয়ে বেজে উঠেছে মুলতানি—বিদায়ের রাগ।
মেলার পরিবেশ নিয়ে প্রতিবারই কথা হয় বিস্তর, কাজ হয় কম। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবার ঘোষণা দিয়েছেন, সামনের বছর মেলা হবে শুধুই প্রকাশকদের। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘এ কাজ করতে তো বাংলা একাডেমীকে অনেক কঠোর হতে হবে, সাহসী হতে হবে, পারবেন তো?’ বললেন, ‘পারব। বাধা আছে অনেক—ভেতরে, বাইরে। তবু করতে হবে।’
শামসুজ্জামান খান আরও জানালেন, এক মাস মেলা করা খুবই কষ্টকর। এতে মেলায় আজেবাজে বইও বেশি ঢুকে পড়ে। মেলায় বেশি পরিমাণ মানসম্মত বই পেতে হলে মেলার সময় কমানো দরকার। আন্তর্জাতিক বইমেলাগুলো যে স্বল্প সময়ের হয়, এটা তারও একটা কারণ।
জিজ্ঞেস করি, পাঁপড়-ফুচকা-বাদাম, চুড়িওয়ালা-ফেরিওয়ালা, খেলনা-দোলনা, মাটি-কাঠের সামগ্রী আর পাইরেটেড বই কণ্টকিত মেলাসংলগ্ন রাস্তার কী হবে?
বললেন, ‘এর পুরোটা তো আমাদের হাতে নেই। তবে চেষ্টা থাকলে এটারও সমাধান করা যাবে।’ মহাপরিচালকের এই আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখতে পাঠক আরও ১১ মাস অপেক্ষায় থাকুন।
নতুন বই
গতকালও মেলায় এসেছে ১৩৭টি নতুন বই। এর মধ্যে আছে সূচীপত্র থেকে প্রকাশিত উম্মে মুসলিমার নারীবিষয়ক বই নারী বলে আত্মশ্লাঘা বোধ করি, বিজয় প্রকাশ থেকে মাহবুব তালুকদারের কবিতার বই প্রেমের চতুর্দশী, নবযুগ প্রকাশনী থেকে মাহবুবুল হকের প্রবন্ধের বই প্রবন্ধ সংগ্রহ, পাঠক সমাবেশ থেকে মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার বই বেহুলার শাড়ি, বর্ষদুপুর থেকে শামসুজ্জামান খানের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই জিজ্ঞাসা ও জবাব ইত্যাদি।
এ ছাড়া মূর্ধন্য থেকে রবীন্দ্রস্মারক গ্রন্থ সিরিজের ৩২টি নতুন বই এসেছে গতকাল মেলায়। এই বইগুলোর মধ্যে আছে: আহমেদ আমিনুল ইসলামের রবীন্দ্রনাথ: কৌতুক নাটক, আলী ইমামের রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ, তারিক মনজুরের রবীন্দ্রনাথ: প্রথম দশ বছর, তপন চক্রবর্তীর রবীন্দ্রনাথ: বিজ্ঞানমনস্কতা ইত্যাদি।
অতি সম্প্রতি মেলায় এসেছে ঐতিহ্য থেকে আনিসুজ্জামান ও মালেকা বেগম সম্পাদিত নারীর কথা (বাঙালি নারীর অধিকার-সম্পর্কিত ভাবনা), অন্যপ্রকাশ থেকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পায়ের তলায় খড়ম, প্রথমা থেকে নজরুল ইসলামের প্রবন্ধের বই আগামী দিনের বাংলাদেশ, বিদ্যাপ্রকাশ থেকে মোহিত কামালের উপন্যাস অহনা।
নজরুল মঞ্চে
বাংলা একাডেমীর সমন্বয় ও জনসংযোগ বিভাগের তথ্যমতে, গতকাল বইমেলার নজরুল মঞ্চে ৪৩টি বইয়ের মোড়ক খোলা হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের ডিসেন্ট্রালাইজেশন অ্যান্ড দ্য লোকাল স্টেট: পলিটিক্যাল ইকোনমি অব লোকাল গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন ড. কামাল হোসেন। রিয়াজুল কবীর কাওছারের আইন বিধিমালা তথ্য ও ফলাফল, বাংলাদেশ নির্বাচন (১৯৪৭-২০১২) গ্রন্থের মোড়ক খোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার
গতকাল সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১২ ঘোষণা করা হয়েছে। এবার ‘ক’ শাখায় উপন্যাসে প্রথমা থেকে প্রকাশিত রামগোলাম গ্রন্থের জন্য হরিশংকর জলদাস, প্রবন্ধে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত জারি গানের আসরে বিষাদ-সিন্ধু গ্রন্থের জন্য যৌথভাবে সাইমন জাকারিয়া ও নাজনীন মর্তুজা, কবিতায় অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত কবিতাপুর গ্রন্থের জন্য শাহাবুদ্দীন নাগরী, শিশুসাহিত্যে (যৌথভাবে) অনন্যা থেকে প্রকাশিত ইতিহাস স্যার গ্রন্থের জন্য লুৎফর রহমান রিটন ও মানিকের লাল কাঁকড়া গ্রন্থের জন্য আনজীর লিটন এবং শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ শাখায় ইতিহাস স্যার গ্রন্থের জন্য আফজাল হোসেন এ পুরস্কার পেয়েছেন।
এ ছাড়া ‘জীবনের প্রথম বই’ ক্যাটাগরিতে ‘খ’ শাখায় কবিতায় সোনেলা রোদের সাঁকো গ্রন্থের জন্য মাজহার সরকার পুরস্কার পেয়েছেন।
গতকাল বাংলা একাডেমীতে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়। সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কারের মূল্যমান ‘ক’ শাখায় প্রতিটি ২৫ হাজার টাকা, ‘খ’ শাখায় প্রতিটি ১০ হাজার টাকা।

No comments

Powered by Blogger.